লক্ষীপুর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ২০:২৪ পিএম
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫২ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ইসমাইল হোসেন সোহাগ। কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও নিজ চেষ্টায় এসেছেন এত দূর। পরিবারে আছে দরিদ্রতার কষাঘাত, আছে নিরক্ষতার প্রভাব। এ অবস্থায় প্রতিবেশীর প্রতারণার শিকার হয়ে মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু হারাতে বসেছে সোহাগের পরিবার। কৌশলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সকল রাস্তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, সোহাগের দাদা আলী আহম্মদ পাটওয়ারী ১৯৮১ সাল নাগাদ লক্ষীপুরের কমলনগরের উত্তর চরলরেন্স মৌজার ৬৯ শতাংশ খাসজমিতে ঘর করে বসতি গড়ে তোলেন। প্রায় ৪২ বছর ধরে ওই জমিতেই পরিবার নিয়ে থাকছেন। নিরক্ষর মানুষটি পেশায় ছিলেন কৃষিশ্রমিক। কয়েক বছর পর জমিটি বন্দোবস্ত নিতে তিনি স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করেন। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে স্থানীয় জয়নাল মেম্বর বাড়ির বাসিন্দা আবুল কালামের সঙ্গে। আলী আহম্মদের সমস্যার কথা শুনে আবুল কালাম তাকে জমি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। জমি পেতে হলে ১ লাখ টাকা খরচ দিতে হবেও বলে জানান তিনি। স্থানীয় গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে আবুল কালামকে ৮০ হাজার টাকা দেন আলী আহম্মদ। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় আরও টাকা দেওয়া হয় তাকে।
টাকা দেওয়ার পর কৌশলে আলী আহম্মদের বাড়ির আশপাশের খাসজমি দখলে নেয় আবুল কালাম। কিছু দিন পর জমি বন্দোবস্ত হয়েছে বলে জানানো হয় তাকে। কিন্তু কখনও কাগজপত্র দেওয়া হয়নি তাকে। সাত বছর আগে আবুল কালাম হজ করতে যান, ফিরে এসেই দলিল বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। সেটাও হয়নি। এর মধ্যে শোনা যায়, আবুল কালাম তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও তিন মেয়ে-জামাইসহ আটজনের নামে চারটি পৃথক নথিতে ১৯৫ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে। তবে আলী আহম্মদের নামে কোনো জমি নেওয়া হয়নি। বিষয়টি জানতে পেরে তিনি নাতি সোহাগকে সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কাগজপত্র উত্তোলন করেন। এতে দেখা যায়, দখলে থাকা জমিটিও আবুল কালাম স্বজনদের নামে করে নিয়েছে।
জানা গেছে, আবুল কালাম নিজের নামসহ তার স্ত্রী শাহিনুর বেগম, মেয়ে কামরুন নাহার, সামছুন নাহার সুমি, নুর নাহার লিপি ও তিন মেয়ের জামাই ইসমাইল হোসেন, আবুল হাসনাত খোকন ও আবুল বাশারের নামে জমির কাগজ করে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে আলী আহম্মদ পাটওয়ারী বলেন, ’৪২ বছর ধরে আমি ৬৯ শতাংশ জমিতে বসবাস করছি। এ বাড়ির সব গাছপালা আমার হাতে লাগানো। কিন্তু আবু আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ২০২২ সালে আবু মারা যায়। জানাজার সময় তার বড় মেয়ের জামাই ইসমাইল হোসেন আমার দখলে থাকা জমি আমাকে দেবে বলেছিল। এখন উল্টো বাড়ি থেকে বের হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। এখন আমাদের ধানক্ষেতের আইল দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।’
পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে ঢাকা থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গ্রামে আসতে হয় সোহাগকে। দখলে থাকা খাসজমি বন্দোবস্ত পেতে ঘুরতে হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে।
কথা হয় ইসমাইল হোসেন সোহাগের সঙ্গে। তিনি বলেন, ’আবু মিয়াদের নামে করা নথি বাতিলের জন্য আবেদন করেছি আমরা। এ নিয়ে ১৩ মার্চ ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদনও আমাদের পক্ষে এসেছে। যার বিরুদ্ধে আবুল কালামের মেয়ের জামাই ইসমাইলসহ অন্যান্যরা উপজেলা সার্ভেয়ার এনে একতরফা একটি প্রতিবেদন তাদের পক্ষে করে নেয়। এ ঘটনায় তদন্তে আসার ব্যাপারে আমাদের আগে থেকে জানানো হয়নি। ৭ নভেম্বর আমরা ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ’প্রতি মাসেই আমাকে বাড়িতে আসতে হয়। এতে আমার পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। এই ৬৯ শতাংশ সরকারি খাসজমিই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। আমাদের এ জমি বন্দোবস্ত দিতে সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তোরাবগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী শাহ আলম বেপারি বলেন, ’জমি বন্দোবস্ত নিয়ে আলী ও আবুর লেনদেনে আমি শুরু থেকে সাক্ষী ছিলাম। আলী সকল টাকা আমার মাধ্যমেই আবুকে দিয়েছে। শুধু ৮০ হাজার টাকা নয়, আবু বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে আরও টাকা নিয়েছে।’
আবুল কালামের মেয়ের জামাই ইসমাইল হোসেন বলেন, ’জমিটি আমার শ্বশুরের। তিনি আমাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছেন। আলী আহম্মদকে মানবিক দৃষ্টিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি অন্যত্র যাচ্ছেন না। উল্টো আমাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করছেন। তাদের কোনো জমি নেই।’
চরলরেন্স ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কমকর্তা জাফর আকবর হোসাইন বলেন, ’আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। ঘটনাটি আমার জানা নেই। শুনেছি আমার আগের কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করেছেন।’ তবে বিষয়টি নিয়ে পরিবারটিকে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, ’ঘটনাটি আমার জানা আছে। আমি সোহাগদের এসিল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলাম। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হবে।’