× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বদলে যাওয়া মাতারবাড়ীর গল্প

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:২২ পিএম

আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:০২ পিএম

কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর। প্রবা ফটো

কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর। প্রবা ফটো

এক দশক আগেও যেটি ছিল অবহেলিত জনপদ। সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন ছিল লবণ চাষ ও চিংড়ি ঘের। ওই লবণ চাষের মাঠই এখন হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক হাব। বর্তমান সরকারের গৃহীত একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে একসময়কার অবহেলিত জনপদ ইতোমধ্যেই হয়ে উঠছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্র।

লবণ মাঠ থেকে অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হওয়া জনপদের নাম কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর উত্তর প্রান্তীয় ইউনিয়ন মাতারবাড়ী। এক দশক আগেও এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার মূল উপায় হিসেবে বিবেচিত ছিল চিংড়ি প্রকল্প, লবণ এবং ধান চাষ। সেখানে এখন গড়ে উঠছে দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ীতে নির্মিত হয়েছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার দুটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। গড়ে তোলা হবে দেশের প্রথম স্থলভিত্তিক এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনাল। 

মাতারবাড়ীকেন্দ্রিক সরকারি প্রকল্পের সুফল বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মাতারবাড়ী হবে দেশের অর্থনীতির চেঞ্জ মেকার। এই মাতারবাড়ী বন্দর শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির হাব হবে। মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দরের কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের কানেক্টিভিটি অনেক সহজতর হবে। মাতারবাড়ী বন্দর হয়ে উঠবে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির অন্যতম করিডোর। যার ফলে আমদানি-রপ্তানিতে সময় কমে আসবে। বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো সাশ্রয় হবে দেশের অর্থনীতির। তিনি আরও বলেন, তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল এগুলো দেশের অর্থনীতি যেমন বড় ভূমিকা রাখবে। তেমনি এসব প্রকল্পের কারণে মাতারবাড়ীর সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কানেক্টিভিটি তৈরি হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রাও উন্নত হবে। স্থানীয়দের জন্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মাতারবাড়ী নিয়ে সরকার একটি বৃহৎ পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, শুধু কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আসলে মাতারবাড়ী এমন একটি সম্ভাবনাময় এলাকা, সেখানে সরকার চাইলে সিঙ্গাপুরের মতো একটি পরিকল্পিত বাণিজ্যিক নগর গড়ে তুলতে পারবে। সরকার সেই পথেই হাঁটছে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে এবং ইকোনমিক জোন হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নকে ঘিরে সেখানে একটি পরিকল্পিত টাউনশিপ গড়ে উঠবে। তখন মাতারবাড়ী হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক হাব।

জনপদ বদলে যাওয়ার গল্প

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর। ওই মাসে শুরু হয় মাতারবাড়ী পাল্টে যাওয়ার গল্প। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মাতারবাড়ীতে ‘মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট’-এর সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের কাজ শুরু করে সরকার। সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের পর মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ৪১৪ একর জমিতে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ওই প্রকল্পের আওতায় সরকারের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ, ১৮ দশমিক ৫ মিটার (এমএসএল) গভীরতার একটি চ্যানেল খনন করে। এরপর সরকার সেখানে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। বন্দর নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বর্ধিত করে ৩৫০ মিটারে উন্নীত করা হয়। নির্মিত চ্যানেল ও হারবার নিরাপদ ও সুরক্ষিত করার জন্য সিপিজিসিবিএল ১ হাজার ৭৫৩ মিটার উত্তর ব্রেকওয়াটার, ৭১৩ মিটার দক্ষিণ ব্রেকওয়াটার এবং উত্তর দিকে ১ হাজার ৮০২ মিটার রিভেটমেন্ট নির্মাণ করে। চ্যানেলটি গত ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। 

একই সময়ে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের ১০ মার্চ একনেক সভায় মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর একই বছর জাপানের নিপ্পন কোয়ে জেভিকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার পর একই বছরের নভেম্বর মাসে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হতে যাওয়া প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে। আজ (১১ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী মাতারবাড়ী বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার পর খুব দ্রুত হতে যাচ্ছে বন্দরের প্রথম টার্মিনাল তৈরির কাজ। প্রথম ধাপে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সিভিল ওয়ার্ক কার্যক্রম শেষ করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে সংগ্রহ করা হবে হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট। প্রকল্পের অধীনে প্রাথমিকভাবে ৩টি টাগবোট, একটি পাইলট বোট এবং একটি সার্ভে বোট কেনাসহ কার্গো হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট টিওএস অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার পর ওই বছর ৬ থেকে ১১ লাখ টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছে, ২০৪১ সালে ওই বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন থেকে ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন টিইইউস-এ। 

একই প্রকল্পের আওতায় জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য মাতারবাড়ীতে ২৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে সড়ক পথে সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে বিছিন্ন দীপ এলাকা মহেশখালীর মাতারবাড়ী। এই ২৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলে পাল্টে যাবে মাতারবাড়ীর যোগাযোগব্যবস্থা। 

শুধু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর নয় মাতারবাড়ীকে ঘিরে সরকার এক গুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র সাইটের কাছে এলএনজি ও এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। শিগগিরই মাতারবাড়ীতে নির্মিত হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম স্থলভিত্তিক এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নামে এই টার্মিনালটির গ্যাস রূপান্তরের সক্ষমতা হবে দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট। আর এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পূর্ণাঙ্গ হাব হিসেবে রূপ নিতে যাচ্ছে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী। এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি মাতারবাড়ীতে পরিকল্পিত টাউনশিপ গড়ে তুলতে কাজ করছে সরকার। আবাসিক ও টাউনশিপ ডেভেলপমেন্টের জন্য সার্ভে, মাস্টার প্ল্যান লে-আউট, ড্রয়িং, ডিজাইনের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। গড়ে তোলা হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এক দশক আগেও যে জায়গাটি ছিল অবহেলিত, সেটি এখন হয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আমদানি রপ্তানির সিংহভাগ পরিবহন করা হবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে। ধীরে ধীরে এটি হয়ে উঠবে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ট্রানজিট হাব।

এদিকে মেগা প্রকল্পের কারণে মাতারবাড়ীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও জীবন-জীবিকা নির্বাহ নিয়ে শঙ্কায় আছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের গৃহীত এসব প্রকল্পের আওতায় সিংহভাগ চাষযোগ্য জমি অধিগ্রহণ করাতে এখানকার বেশিরভাগ মানুষ তাদের পেশা হারিয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, সরকারের পক্ষ থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এখানকার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। 

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী স্থানীয় বাসিন্দা মো. জিসান উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকার মাতারবাড়ীতে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। একই সাথে এসব প্রকল্পের কারণে মাতারবাড়ীতে যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির দাবি জানাই।’ তিনি বলেন, বড় বড় প্রকল্পের কারণে মাতারবাড়ীতে আগে যারা লবণ ও চিংড়ি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা পেশা হারিয়েছেন। এদের অধিকাংশ এখন কর্মহীন তাদের কাজের ব্যবস্থা করতে হব। 

স্থানীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হায়দার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এক কথায় বললে উন্নয়নের ছোঁয়ায় পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে মাতারবাড়ী। আমরা বিশ্বাস করি এসব প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটবে। আমাদের এলাকার মানুষ এ কারণে সুযোগ পাবে।’ তিনি সরকারের কাছে এসব প্রকল্পে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার অনুরোধ জানান।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা