রংপুর অফিস
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:৪৫ পিএম
আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৪২ পিএম
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্ণেয়া এলাকায় শতবর্ষী তালগাছে বাবুই পাখি। প্রবা ফটো
শতবর্ষী
তালগাছে বাবুই পাখির কোলাহল। গাছজুড়ে ৩০ থেকে ৩৫টি
পাখির বাসা। উল্টানো কলসি আকৃতির এসব
বাসায় নেচে বেড়াচ্ছে বাবুই।
কেউ খাবার নিয়ে ঢুকছে, কেউ
ঘর মেরামত করছে। কেউবা সঙ্গীর সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত।
কখনও বাতাসে দোল খাচ্ছে বাবুই
পাখির নিজ হাতে গড়া
বাড়ি। একসময় গ্রামবাংলায় বাবুই পাখির কলরব শোনা যেত।
নগরায়ণে গ্রামীণ সৌন্দর্যের তালগাছ এখন বিলুপ্তির পথে।
এমন পরিস্থিতিতে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্ণেয়া এলাকায় সড়কের ধারে শতবর্ষী তালগাছে
বসবাস করে অস্তিত্ব ধরে
রাখার চেষ্টা করছে বাংলার এই
তাঁতিপাখি। কবি রজনীকান্ত তার
‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায় এ
পাখির নিজস্বতা তুলে ধরেছিলেন। তিনি
লিখেছিলেন, ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/কুঁড়েঘরে থেকে
কর শিল্পের বড়াই/আমি থাকি
মহাসুখে অট্টালিকার পরে/তুমি কত
কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি,
ঝড়ে’। এখন এই
পরিশ্রমী পাখিকে দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে
মানুষ আসছে। অনেকে ছবি তুলছে দুর্লভ
পাখি ও দৃষ্টিনন্দন বাসার।
এলাকার
৬৫ বছর বয়সি মজিবর
মিয়া বলেন, ‘এই এলাকাত পুরানো
এই একটাই তালগাছ। এই গাছ মোর
শ্বশুরের আমলের। ওমার কতা অনুযায়ী
এই গাছের বয়স দেড়শ বছর।
ছোট্টবেলা থ্যাকি দেখি আসতোছি এটে
বাবুই পাখি বাসা করে
আছে। এলাকার কাইয়ো কিছু কয় না।
পাখি নিজ মনে বাড়িত
থাকে, উড়ি বেড়ায়। দেখবার
ভালোই নাগে।’
বাবুই
পাখি অত্যন্ত পরিশ্রমী। তারা তালপাতা, খড়
ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উল্টানো কলসির
মতো বাসা বানায়। বাবুই
পাখির শক্ত বুননের বাসা
শিল্পের অনন্য সৃষ্টি। যত্ন করে পেট
দিয়ে ঘরের গোল অবয়ব
মসৃণ করে। শুরুতে দুটি
নিম্নমুখী গর্ত থাকলেও পরে
একদিক বন্ধ করে ডিম
রাখার জায়গা করে। অন্য পথটি
ব্যবহার করা হয় বাসায়
প্রবেশ ও বের হওয়ার
জন্য। এদের বাসা অত্যন্ত
আকর্ষণীয় ও মজবুত হয়।
প্রবল ঝড়ে ও বাতাসে
তালগাছ থেকে বাসা পড়ে
যায় না।
বাবুই পাখিওয়ালা তালগাছ দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসে। হারাগাছ কলেজ এলাকার মিলন মিয়া বলেন, ‘আমরা প্রায়ই বাবুই
পাখির আকর্ষণীয় বাসা দেখতে যাই।
এছাড়া এখনকার যেসব তালগাছ রয়েছে,
সেখানে বাবুই পাখি বাসা করে
না। শুধু ওই একটি
গাছেই বাবুই পাখি রয়েছে।’ পাঠ্যবইয়ে
বাবুই পাখির পরিশ্রম ও নিজস্বতার কথা
পড়েছেন জানিয়ে শিক্ষার্থী ওসমান মিয়া বলেন, ‘এই
পাখি মানুষকে পরিশ্রমী হতে শেখায়; নিজের
সম্পদ নিয়ে খুশি থাকতে
শেখায়।’
কথিত
আছে, রাতে বাসায় আলো
জ্বালানোর জন্য বাবুই পাখি
জোনাকি ধরে আনে এবং
সকালে ছেড়ে দেয়। বাবুই
পাখি সাধারণত খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন ধরনের ঘাস, পোকা, ছোট্ট
উদ্ভিদ, ফুলের মধু, রেণু, বীজ,
ধান ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ
করে।
কয়েক
বছর ধরে পাখি নিয়ে
ফটোগ্রাফি করেন প্রকৌশলী একেএম
ফজলুল হক। তিনি বলেন,
‘আমি অনেক পাখির ছবি
তুলেছি। কিন্তু বাবুই পাখি পাওয়া দুষ্কর
হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ একসময় প্রতিটি
গ্রামাঞ্চলে সারি সারি তালগাছের
পাতায় বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেত।
নগরায়ণের কারণে গ্রামাঞ্চলে তালগাছ নিধন হচ্ছে। এতে
বাবুই পাখি তাদের আবাসস্থল
হারাচ্ছে। অনেক পাখি শিকার
হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পরিবেশগত কারণেও বাবুই পাখির সংখ্যা মারাত্মভাবে কমে গেছে। এসব
পাখি সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ও উদ্যোগ বাড়াতে
হবে।’
সামাজিক
বন বিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা
মোশাররফ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গ্রামবাংলার ঐতিহ্য তালগাছ, খেজুরগাছ হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে পাখিদের আবাসস্থল
নষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে বাবুই পাখি
এখন বিলুপ্তপ্রায়। তালগাছের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সামাজিক বন বিভাগের নার্সারিতে
আমরা উদ্যোগী হয়ে এ বছর
তিন হাজার তালগাছের চারা উৎপাদন করছি।
সেই চারা বিভাগের বিভিন্ন
এলাকায় রোপণ করব এবং
জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। এছাড়া
বজ্রপাত মোকাবিলায় সরকারের তালগাছ রোপণেরও উদ্যোগ রয়েছে। উত্তরাঞ্চলে যেহেতু বজ্রপাতে প্রতিবছর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তালগাছ রোপণ হলে বজ্রপাত
রোধ হবে এবং বাবুই
পাখি তার আবাসস্থল ফিরে
পাবে।