নড়াইল সংবাদদাতা
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২২ ১৭:২৭ পিএম
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২২ ২০:২২ পিএম
এস এম সুলতান ও তার পালিত মেয়ে নিহার বালা। ফাইল ফটো
চিরকুমার এস এম সুলতানকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে মানুষটি মায়া-মমতা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, কেমন আছেন সেই নিহার বালা? এক কথায়, মোটেও ভালো নেই সুলতানের পালিত কন্যা নিহার বালা। তিনি তার নাতির সঙ্গে সে ঘরটিতেও থাকেন, বৃষ্টি হলে সেখানে পানি পড়ে।
চোখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রোগে-শোকে জীবন এখন আর যেন চলে না তার। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে জীবন-মৃত্যুর ক্ষণ গুনছেন তিনি।
নিহার বালার নাতি নয়ন বৈদ্য প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বোহেমিয়ান সুলতানকে শিল্পকর্মে মনোনিবেশ করানোর জন্য যে মানুষটি তার পাশে ছায়ার মতো ছিলেন, তিনিই তার পালিত কন্যা নিহার বালা। তার জন্যই আমরা পেয়েছিলাম সুলতানের বিশ্বমানের সব চিত্রকর্ম। নিহার বালার কাছ থেকে সুলতানের মূল্যবান চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেই সুলতান সংগ্রহশালা তৈরি করেছে সরকার।’
এস এম সুলতানের মৃত্যুর পর দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত লোকজন আসত সুলতান সম্পর্কে জানতে। আর নিহার বালাও পরম মমতায় তাদের শোনাতেন সুলতানের ভালো-মন্দসহ ছবি আঁকার গল্প। এখনও অনেকে আসে নিহার বালাকে দেখতে। তবে এখন আর তিনি চলাফেরা, কথা বলতে পারেন না। কয়েক বছর আগে তিনি অন্ধত্ব বরণ করেন।
নয়ন বৈদ্যর স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘আমরা ছাড়া নিহার বালাকে দেখার মতো কেউ নেই। যে ঘরটিতে তিনিসহ আমরা বসবাস করি, বৃষ্টি হলে সে ঘরটিতেও মাঝে মাঝে পানি পড়ে।’ নিহার বালার জন্য একটি ঘর ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
এস এম সুলতান চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের সভাপতি ভক্ত শেখ হানিফ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সুলতানের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে লাখ লাখ টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান করা হয়। অথচ শিল্পকলা একাডেমি থেকে নিহার বালার জন্য পাঁচ হাজার টাকা এবং জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় আরও পাঁচ হাজার টাকাসহ এই ১০ হাজার টাকায় চলে নিহার বালার খরচ, যা খুবই সামান্য। তার মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। তিনি নিহার বালার উন্নত চিকিৎসার দাবি জানান।
এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের কিউরেটর তন্দ্রা মুখার্জী জানান, এস এম সুলতানের সকল বিষয়ে তার থেকে ভালো আর কেউ জানত না। সুলতানকে জানতে হলে নিহার বালাকে অবশ্যই জানতে হবে। তিনি মায়ের মতো করে আগলে রেখেছিলেন।
বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এস এম সুলতান। তিনি নড়াইলবাসীর কাছে ‘লাল মিয়া’ বলে পরিচিত। বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুর পর তার বাসভবন ঘিরে গড়ে উঠেছে সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা, শিশুস্বর্গ, কলেজসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। ধান কাটা, ধান ঝাড়া, জলকে চলা, চর দখল, গ্রামের খাল, মৎস্য শিকার, গ্রামের দুপুর, নদী পারাপার, ধান মাড়াই, জমি কর্ষণে যাত্রা, মাছ ধরা, নদীর ঘাটে, ধান ভানা, গুন টানা, ফসল কাটার ক্ষণে, শরতের গ্রামীণ জীবন, শাপলা তোলার মতো বিখ্যাত সব ছবি এঁকেছেন সুলতান।
চিত্রশিল্পে অনন্য অবদানের জন্য এস এম সুলতান ১৯৮২ সালে পেয়েছেন একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৪ সালে রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননাসহ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার পেয়েছেন। এদিকে, ২০০১ সাল থেকে সুলতান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একজন গুণী চিত্রশিল্পীকে সুলতান পদক দেওয়া হচ্ছে।
বরেণ্য এই শিল্পী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রাম এলাকায় সংগ্রহশালা চত্বরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এস এম সুলতান।
প্রবা/ইউরি/টিকে/টিই