এস এম রানা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৩ ১১:২৩ এএম
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪৮ পিএম
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’—এমন স্লোগানে পূর্ব বাংলার জনপদ আন্দোলনে মুখর হয়েছিল ১৯৫২ সালে। ভাষা আন্দোলনকালে ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ইতিহাস রচিত হয়েছিল এই জনপদে। ওই সময় পাকিস্তানিরা বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েও পারেনি। বাঙালির মুখে ভাষার দ্যুতি এখন ছড়াচ্ছে বিশ্বময়।
সেই ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে অবাঙালিদের হাত ধরে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করা একটি ইস্পাত কারখানার দ্যুতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাংলাদেশে। দীর্ঘ ৭১ বছরের পথ পরিক্রমায় ২০২৩ সালে এসে বার্ষিক সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম)।
একসময়ের বাণিজ্যমুখর জনপদ খাতুনগঞ্জ, যেটি এখন প্রায় ম্রিয়মাণ বাজারে পরিণত হচ্ছেÑ সেই খাতুনগঞ্জ থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে বসে অবাঙালি পরিবারের হাতে গড়া শিল্পকারখানা বিএসআরএমের এই ইস্পাতদ্যুতি দেখছে পুরো বাংলাদেশ।
এই শিল্পপরিবারটি দেশভাগের পর ভারতের গুজরাট থেকে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে এসে ব্যবসা শুরু করেছিল। যে ব্যবসার সুবাদে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের সুখ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে পরিবারটি ইস্পাতশিল্পের দিকে মনোযোগ দিয়ে ১৯৫২ সালে প্রথম কারখানা স্থাপন করে। আটটি কারখানা নিয়ে বিএসআরএম এখন সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছে। বিএসআরএম শিল্পপরিবারের উত্থানগাথা বেশ সাবলীলভাবেই বর্ণনা করেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমের আলী হুসেইন। আর কোম্পানি পরিচালনার কার্যক্রম বিষয়ে তথ্য দেন ডিএমডি তপন সেনগুপ্ত।
যাত্রা শুরু ১৯৫২ সালে
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাদের পরিবার প্রথমে পাকিস্তানের করাচিতে স্থানান্তর হয়েছিল। পরের বছর ১৯৪৮ সালে পরিবারটি চট্টগ্রামে চলে আসে। সেই সময় চট্টগ্রামে বড় ধরনের কোনো শিল্পকারখানা ছিল না। তখনই পরিবারটি ইস্পাতশিল্পে বিনিয়োগের চিন্তা করে। এরপর ১৯৫২ সালে নাসিরাবাদ এলাকায় প্রথম ‘ইস্ট বেঙ্গল রি-রোলিং মিলস’ কারখানা স্থাপন করে। ওই কারখানার জন্য দক্ষ কারিগর আনা হয়েছিল কলকাতা এবং শ্রমিক আনা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। এটিই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রিং-রোলিং মিল।
পরের ৭১ বছরে কারখানা উন্নীত হয় আটটিতে। এসব কারখানায় বছরে ১৬ লাখ টন রড এবং ১৮ লাখ টন বিলেট উৎপাদিত হয়। আরও একটি কারখানা যাত্রা শুরুর অপেক্ষায় আছে। নবম কারখানা চালু হলে উৎপাদন বাড়তে পারে আরও ৭ লাখ টন।
আমের আলী হুসেইনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫২ সালে স্থাপিত প্রথম কারখানায় উৎপাদিত হতো ৪০ গ্রেডের রড। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এরপর আমাদের সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন। পরে তিনি আমাদের সবকিছু ফিরিয়ে দেন। তখন দ্বিতীয় দফায় নতুন করে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড নামে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে সেমি অটোমেটেড প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। তখন থেকে আন্তর্জাতিক মানের ৬০ গ্রেডের রড উৎপাদন শুরু হয়। তবে শিল্পের প্রসার বাড়ে ১৯৯০ সালের পর। যা এখনও চলছে। অদূরভবিষ্যতে নতুন একটি কারখানা চালুর প্রক্রিয়া চলমান। যেটি চালু হলে প্রায় ৭ লাখ টন উৎপাদন বাড়বে।
বিএসআরএমের ডিএমডি তপন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, বিএসআরএমের উৎপাদিত রড আন্তর্জাতিক মানের। এ কারণে সরকারি সব উন্নয়ন প্রকল্পের সিংহভাগ রড সরবরাহ করে বিএসআরএম। এমনকি পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পের জন্য বিএসআরএমকে ৫০ এমএম রড উৎপাদন করতে হয়। সরকারি মেগা প্রকল্পে রড সরবরাহের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১০০ শতাংশ, পদ্মা রেলসেতুতে ৯০ শতাংশ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে ৭২ শতাংশ, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল প্রকল্পে ৬৪ শতাংশ, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ৩০ শতাংশ, ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পে ৩০ শতাংশ, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫৮ শতাংশ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪৯ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত উড়ালসড়কে ৪১ শতাংশ রড সরবরাহ করে বিএসআরএম। সরকারি মেগা প্রকল্পে রড সরবরাহ করে নিজদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে রড সরবরাহ স্বাভাবিক রেখেছে বিএসআরএম। এ কারণে তাদের রডের ঘাটতি দেখা দেয়নি বাজারে।
স্থানীয় চাহিদা পূরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেগা প্রকল্পে ইস্পাত সরবরাহ করে মুনাফা বাড়িয়েছে শিল্পপরিবারটি। তাদের হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী, বার্ষিক ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করা কোম্পানির তালিকায় উঠেছে বিএসআরএম। এটি বাংলাদেশের চতুর্থ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এর আগে তিতাস গ্যাস, গ্রামীণফোন এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড এই গৌরব অর্জন করেছিল।
বিএসআরএম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের আয় হয়েছে ১১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সংকট, ডলার সংকট, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, কাঁচামালের সংকটের মধ্যেও কোম্পানিটি আগের বছরের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি মুনাফা করতে সক্ষম হয়।
বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে প্রায় সব মেগা প্রকল্প উদ্বোধন হচ্ছে। তাই আগামী বছর দেশে ইস্পাতের চাহিদা সরকারিভাবে কমবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএসআরএমের বাণিজ্যিক পরিকল্পনা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘স্থানীয় চাহিদা মেটাতে হবে। সরকারি চাহিদা কমলে উৎপাদনে তা সমন্বয় করা হবে।’
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্যানুসারে, দেশে এমএস রডের বার্ষিক চাহিদা ৭০ দশমিক ৭৫ লাখ টন। প্রায় ৫৫টি অটো স্টিল রি-রোলিং মিল এবং শতাধিক সেমি অটো এবং ম্যানুয়েল মিল এই রডের চাহিদা পূরণ করে। তবে কয়েকটি বড় কোম্পানির কারখানায় আন্তর্জাতিক মানের রড উৎপাদন হয়। ওই বড় কারখানাগুলোই রডের বাজারে আধিপত্য ধরে রেখেছে।