× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

খাতুনগঞ্জে ম্রিয়মাণ ‘বাণিজ্যিক সূর্য’

এস এম রানা, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:২৯ এএম

আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৫৪ পিএম

খাতুনগঞ্জে ম্রিয়মাণ ‘বাণিজ্যিক সূর্য’

খাতুনগঞ্জে ম্রিয়মাণ ‘বাণিজ্যিক সূর্য’

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে চট্টগ্রামের খ্যাতিমান সওদাগর খান বাহাদুর শেখ মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ খান (১৮০৯-১৮৮০) তার দ্বিতীয় স্ত্রী খাতুন বিবির নামানুসারে স্থাপন করেন খাতুনগঞ্জ বাজার। একাত্তরের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এটিই হয়ে ওঠে বন্দর নগরীর অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র।

সত্তর-আশির দশকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল শিক্ষিত তরুণ ভাগ্যবদলের অন্বেষণে যুক্ত হন এই খাতুনগঞ্জে। তাদের কেউ এসেছিলেন পেটের দায় মেটাতে চাকরির সন্ধানে, কেউ প্রায় পুঁজিশূন্য হাতে ব্যবসা করতে কিংবা কেউ এসেছিলেন চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার মানসে। ‘খাতুনবিবির’ উর্বর জমিতে নতুন করে জীবনের চাষ শুরু করেছিলেন তারা। চার থেকে পাঁচ দশকের ব্যবধানে সেই তরুণদের মেধা এবং কর্মদক্ষতায় পুরো বাংলাদেশ দেখল খাতুনবিবির আকাশে উজ্জ্বল বাণিজ্যিক সূর্যের উদয়। 

চট্টগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খ্রিস্টীয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে এখানে আরব বণিকেরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসতেন। বাদ যাননি পর্তুগিজ, ফরাসি বা তুর্কিরাও। ওই সময় চট্টগ্রামকে বলা হতো ‘গেটওয়ে অব দি ইস্ট।’ সাগরপথে আরব বণিকদের প্রবেশদ্বার ছিল কর্ণফুলী নদী। যে কর্ণফুলীর মোহনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান। বন্দর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার উজানে নদীর তীরবর্তী খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আছাদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জ এলাকায় বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে।

এই এলাকাটিই পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভোগ্যপণ্য এনে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে বিক্রি করে বণিকেরা আশাতীত সাফল্য পেতেন। সেই সাফল্যকে পুঁজি করে একাধিক শিল্প গ্রুপ খাতুনগঞ্জের এই বাণিজ্যিক আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। 

খাতুনগঞ্জ হয়ে ওঠে দেশের একাধিক খ্যাতিমান শিল্প গ্রুপের আতুরঘরও। যে আতুরঘরে জন্ম নেওয়া একাধিক শিল্প গ্রুপ এখন সগৌরবে সারা দেশে আলো ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম গ্রুপ এস আলম, কেডিএস, পিএইচপি, টিকে, বিএসএম, জিপিএইচ, পারটেক্স, মেঘনা ও সিটি গ্রুপ। 

এসব খ্যাতনামা শিল্প গ্রুপের পাশাপাশি আরও কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর অংশগ্রহণে দুই দশক আগেও খাতুনগঞ্জে রমরমা বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছিল। ওই সময় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ব্রোকার এবং ডিও ব্যবসায়ীদের ভিড়, দরদামের হাঁকডাক ও শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততায় মুখর থাকত চারপাশ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই মুখর বাণিজ্যের সুদিন এখন আর নেই। সরু সড়কে তীব্র যানজট, শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা, নৌকা কিংবা সাম্পান মাঝিদের ব্যস্ততা যেন ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। 

বিদায় নেওয়ার তালিকায় অনেক আগেই যুক্ত হয়েছিল বাঙালি-অবাঙালি প্রথা। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায় স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাঙালি ও অবাঙালি-দুই ধারার বিভক্তরেখা ছিল। ৬০-৭০-এর দশকে অবাঙালি তথা গুজরাট ও মুম্বাইয়ের ব্যবসায়ীদের আমদানির অনুমতি ছিল। তাই তারা ভালো ব্যবসা করতেন। অবাঙালিদের আমদানি করা পণ্য কিনে ব্যবসা করতেন বাঙালিরা।

ফলে ওই সময় অবাঙালিরা ছিলেন দাপুটে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং ৮০-এর দশকে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির পর বাঙালি ব্যবসায়ীরা দ্রুতগতিতে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন। 

এখানে দোকান-গুদাম ও ব্যবসাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে অন্তত ছয় হাজার। আর্থিক যোগ বাড়ায় ট্রেড ইউনিয়ন ও ব্যবসায়িক সংগঠন গড়ে ওঠার পাশাপাশি স্থাপিত হয় ব্যাংকসহ নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৬০টি শাখা। সঙ্গে যুক্ত হয় ইনস্যুরেন্স কোম্পানির শাখা, ব্রোকারেজ হাউজ ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখনও মাত্র তিন বর্গকিলোমিটার আয়তনের খাতুনগঞ্জে দৈনিক অন্তত ২৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। 

৯০-এর দশকের সোনালি সময় পার করার পর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের পর খাতুনগঞ্জের ব্যবসায় ভাটার টান শুরু হয়। একসময় ভোগ্যপণ্যের প্রায় সব পণ্যই খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক থাকলেও এখন দেশের নানা প্রান্তে আরও একাধিক পাইকারি বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে খাতুনগঞ্জ তার আধিপত্য হারিয়েছে। একসময় দেশের চাহিদার অন্তত ৮০ শতাংশ এখান থেকে সরবরাহ হলেও এখন হচ্ছে ৫০-৫৫ শতাংশ। 

যেমন ছিল সোনালি সময়

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ কিংবা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেলের বাজারে টিকে, আবুল খায়ের, এমইবি, মোস্তফা, এসএ, এনজিএসসহ ১২টি গ্রুপের প্রতিযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে ডিওর হাতবদল হতো, ব্রোকারদের জটলা লেগে থাকত। আবার এস আলমসহ অন্য কোম্পানির চিনি, বিএসএম গ্রুপের গম নিয়ে সরগরম থাকত বাজার। এখানে দরবৃদ্ধির উত্তাপের সঙ্গে দরপতনে পিনপতন নীরবতাও থাকত ছায়াসঙ্গী হয়ে। শুধু কি ভোজ্যতেল, গম-চিনি? সঙ্গে ছিল ভোগপণ্যের অন্য অনুষঙ্গগুলোও।

শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন এনজিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রয়াত ননী গোপাল সাহা, পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান, কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ, বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী, টিকে গ্রুপের আবুল কালাম ও আবু তৈয়ব, মোস্তফা গ্রুপের প্রয়াত মোস্তাফিজুর রহমান, এমইবি গ্রুপের প্রয়াত মোহাম্মদ ইলিয়াছ, এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন আলম এবং বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের হেফাজতুর রহমানের মতো মেবাধী ব্যবসায়ীরা।

আবার খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন ও চট্টগ্রাম চেম্বারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে দিতে এখন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মাহবুবুল আলম। এটাও খাতুনগঞ্জের গৌরবের মুকুটে নতুন পালক যুক্ত করেছে। 

যেসব কারণে সংকটে খাতুনগঞ্জ

এমন রমরমা ব্যবসার মধ্যেই দশক না ঘুরতে এখন খাতুনগঞ্জের জৌলুস কমেছে চোখে পড়ার মতোই। বড় একাধিক গ্রুপের কর্ণধার ঋণখেলাপির দায় মাথায় নিয়ে দেশান্তরী হয়েছেন। আবার এসএ গ্রুপের মতো একাধিক গ্রুপ টিকে থাকার প্রাণান্ত লড়াই করছে মাটি কামড়ে ধরে। দেশ না ছেড়ে ব্যবসাকে ঘুরে দাঁড় করানোর এই যুদ্ধে এসএ গ্রুপের এই প্রচেষ্টাকে অনেক ব্যবসায়ী ইতিবাচক হিসেবেই দেখেন। 

বছরজুড়ে যানজট, বর্ষাকালে জলজট, নাব্যতা হ্রাসের শিকার চাক্তাইখালে নৌ চলাচলের সরু পথ রেখে স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি, সারা দেশের কোথাও মহাসড়কে ওজনস্কেল না থাকলেও শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড ও দাউদকান্দি এলাকায় ওজনস্কেল বসিয়ে ট্রাকে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই পরীক্ষা চালু, ডিও ব্যবসার নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরিসহ নানা কারণে খাতুনগঞ্জ নিজের জৌলুস হারাচ্ছে। 

বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, খাতুনগঞ্জ এখন নানামুখী সমস্যার শিকার। সরু সড়ক সম্প্রসারণ হওয়া দরকার। যানজট নিত্য সমস্যার তালিকার শীর্ষ রয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল, ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক সরকারি দপ্তরগুলোর বেশিরভাগই ঢাকায়। উচ্চ আদালতের সার্কিট ব্রাঞ্চও নেই চট্টগ্রামে। ফলে ঋণপত্র-সংক্রান্ত আইনি জটিলতায় ঢাকায় দৌড়াতে হয়। 

আবার এ পাইকারি বাজারের অবকাঠামোগত সমস্যা নিয়ে কিছুটা ক্ষোভও রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বিশেষ করে বর্ষাকালে বেশ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এখানে। যানজটে নাকাল খাতুনগঞ্জে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ রাখা, রাস্তা সম্প্রসারণ, বর্জ্য অপসারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক সরকারি দপ্তরগুলোর শাখা খোলা উচিত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

বাণিজ্যিক গৌরব হারিয়ে ক্রমশই ম্রিয়মাণ হচ্ছে খাতুনগঞ্জের বাণিজ্যিক সূর্য। কেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসার এই অবস্থা? বনেদি ব্যবসায়ীরাও প্রতিনিয়ত এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমের ভাষ্য অনুযায়ী, অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে ব্যবসা ছেড়েছেন। ডিও ব্যবসায়ী প্রতারণা শুরুর পর অনেক ভালো ব্যবসায়ী বড় অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজনস্কেল বসানোর পর দেশের অন্য জেলার সঙ্গে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের আউটার থেকে লাইটার জাহাজে করে ঢাকাসহ দেশের অন্য জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।

এতে খাতুনগঞ্জের ব্যবসা কমেছে। আবার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা যখন ট্রেডিংয়ে বেশি মনোযোগী তখন দেশের অন্য জেলার শিল্প গ্রুপগুলো মোড়কজাত পণ্য বিক্রিতে মনোযোগী হয়। খাতুনগঞ্জের খোলা পণ্যেও সঙ্গে মোড়কজাত পণ্যের একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সেই প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামের গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ট্রেডিংয়েই মনোযোগী ছিলেন। ফলে ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে। 

খাতুনগঞ্জ থেকে উঠে গিয়ে এফবিসিসিআইয়ের মতো বড় সংগঠনের সভাপতির মতো গুরুদায়িত্ব নেওয়ার পরও কেন সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করে ওজনস্কেল সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা চেষ্টা করছি। সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, হয় সারা দেশে একই ধরনের ওজনস্কেল স্থাপন করা হোক, অন্যথায় চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের ওজনস্কেল বন্ধ করা হোক। এক দেশে এক আইন কার্যকর থাকুক। এখন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের স্রোতের বিপরীতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এটা অবশ্যই বন্ধ হওয়া জরুরি।’ 

জৌলুস হারানোর আরও কিছু কারণ 

খাতুনগঞ্জে বড় আকারে ভোগ্যপণ্য আমদানি শুরু করেছিল টিকে গ্রুপ। অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তা নিজস্ব কারখানায় পরিশোধন করত গ্রুপটি। একপর্যায়ে চট্টগ্রামের ১২টি শিল্প গ্রুপ ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা গড়ে তোলে। চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকায় মেঘনা গ্রুপ ও সিটি গ্রুপের পাঁচটি রিফাইনারি কারখানা ছিল। এতে চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপের আধিক্য ছিল। পরবর্তী সময়ে মেঘনা ও সিটি গ্রুপ বীজ থেকে তেল উৎপাদন কারখানা গড়ে তোলে। কিন্তু চট্টগ্রামের কোনো গ্রুপ সেই পথে হাঁটেনি। এ ছাড়াও কিছু গ্রুপ রিফাইনারি কারখানায় লোকসান দিয়ে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। 

আবার একসময় মোস্তফা, পিএইচপি, বিএসএম গ্রুপ, এস আলম চিনি আমদানি করত। পরে ঢাকার সিটি ও মেঘনা গ্রুপ চিনি পরিশোধন কারখানা গড়ে তোলে। কিন্তু চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ ছাড়া আর কেউ সেই পথে হাঁটেনি। এ কারণে চিনির বাজারের একটি অংশ এখন খাতুনগঞ্জ ছাড়া হয়েছে। যদিও এস আলম এখনও চিনি পরিশোধন কারখানা চালু রেখেছে। চিনির মতোই আটা-ময়দার কারখানা গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে বসুন্ধরা, মেঘনা, সিটিসহ একাধিক গ্রুপ কারখানা গড়ে তোলে।

চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে বিএসএম-এসএ গ্রুপের মতো হাতে গোনা কয়েকটি গ্রুপ সেই পথে হাঁটে। এখানেও পিছিয়ে থাকল চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ। খাতুনগঞ্জভিত্তিক শিল্প গ্রুপ যখন ট্রেডিং নিয়ে ব্যস্ত তখন ঢাকাভিত্তিক শিল্প গ্রুপগুলো কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ করে। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের গ্রুপগুলো বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। কারণ ঢাকাভিত্তিক শিল্প গ্রুপগুলো ততদিন মোড়কজাত পণ্যের একটি বড় বাজার তৈরিতে সাফল্য পায়। এখন বাজারে অন্তত ২৫ শতাংশ ভোগ্যপণ্য মোড়কজাত হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। যেখানে চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপগুলোর অংশীদারি নগণ্য। 

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থলবন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্যও। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভোগ্যপণ্যের বড় একটি অংশ আমদানি হয়। একসময় পেঁয়াজ সরবরাহের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ দিয়ে এখন আগের মতো পেঁয়াজ সরবরাহ হয় না। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা পেঁয়াজ সরাসরি অন্য জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। শুধু পেঁয়াজ নয়, আমদানি করা নানা পদের ভোগ্যপণ্যের এখন সরাসরি গন্তব্য ভিন্ন জেলার ভিন্ন পাইকারি বাজার। 

খাতুনগঞ্জের বাণিজ্য কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ জানিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম। তার তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর আমদানির জন্য লাইসেন্স দরকার হতো। যারা এই লাইসেন্স পেতেন, তারা খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। মূল আমদানিকারক ছিলেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরাই। ওই সময় সারা দেশের ভোগ্যপণ্যের ৭৫-৮০ শতাংশ সরবরাহ হতো খাতুনগঞ্জ থেকে। প্রায় তিন দশক আগে লাইসেন্স প্রথা উঠে যাওয়ার পর যে কেউই আমদানি করতে পারেন। ফলে ঢাকাসহ সারা দেশে আমদানিকারকের সংখ্যা বেড়েছে। এতে খাতুনগঞ্জের অংশীদারি কমেছে। 

ব্যবসা ছেড়ে আইনি লড়াইয়ে

ম্রিয়মাণ জৌলুস, পরিকল্পনাহীন নাগরিক ও ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী এখন অন্য এলাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করেছেন। আধুনিক ও সুসজ্জিত ভবনে এখন অফিস করে পিএইচপি ফ্যামিলির মতো শিল্প গ্রুপ। এককালের সওদাগরি-গদি সংস্কৃতির পরিবর্তে গড়ে উঠেছে কর্পোরেট সংস্কৃতি। কর্পোরেট সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপের জৌলুস বেড়েছে।

অন্যদিকে নূরজাহান গ্রুপ ও ইলিয়াছ ব্রাদার্সের (যেটি এখন এমইবি গ্রুপ নামে সর্বাধিক পরিচিত) মতো বেশকিছু শিল্প গ্রুপ ঋণখেলাপি হয়ে ব্যাংকের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে। আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বড় শিল্প গ্রুপের সঙ্গে ছোট ও মধ্যম সারির ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন ঋণের ফাঁদে। শীর্ষ গ্রুপের মধ্যে নূরজাহান গ্রুপ, মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স, ছিদ্দিক ট্রেডার্স ও মোস্তাফা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের কেউ দেশ ছাড়া, কেউ দেশের ভেতরে আত্মগোপনে আবার কেউবা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। 

বড় শিল্প গ্রুপের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঋণখেলাপি হয়েছেন ছোট-মধ্যম সারির ব্যবসায়ীরাও। এ ছাড়া চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ, পায়েল ট্রেডার্স, নুরুল আলমসহ অনেকের নাম আছে তালিকায়। তালিকার এই নাম দীর্ঘায়িত হওয়া শুরু করেছিল ২০১৩ সালের পর থেকে। ওই বছর প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণসহ নানা খাতে বড় অঙ্কের টাকা অনাদায়ী রেখে সপরিবারে কানাডা পালিয়ে যান ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোজাহের হোসেন। মোজাহেরের দেখানো পথে আরও অনেকেই হেঁটেছেন।

ফলে এখন আর ব্যাংকগুলো সহজে ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে না। একসময় সহজ শর্তে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ঋণ দিত ব্যাংকগুলো। এখন নানা শর্তের বেড়াজাল অতিক্রম করেই ঋণ পেতে হচ্ছে তাদের। ব্যাংকের মতো সতর্কতা এসেছে ডিও ব্যবসায়। একসময় মৌখিক কিংবা ছোট্ট কাগজে লিখে ডিও ব্যবসা হতো। এখন চেক দিয়ে ডিও ব্যবসার প্রচলন শুরু হয়েছে। এসবই কিছু প্রতারক ব্যবসায়ীর কুকর্মের ফসল। বলা হচ্ছে, খাতুনগঞ্জে বাণিজ্যিক সূর্যের ম্রিয়মাণ দশার জন্য ঋণখেলাপি ও প্রতারক ব্যবসায়ীদের বড় দায় আছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা