লালন স্মরণোৎসব
জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ২৩:০৭ পিএম
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৩ ১১:০৩ এএম
‘হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায়, ঘিরে নিল কালে, আর কি হবে এমন মানব জনম, বসব সাধু মেলে’- একতারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপন মনে গাইছিলেন সিরাজগঞ্জের প্রবীণ বাউল শওকত আলী। মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের এই গান তার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল জগৎসংসারের গভীর এক বিষণ্নতা নিয়ে। তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব শেষ হতে চলেছে, বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে। তাই হয়তো একনিষ্ঠ এই লালন ভক্তের কণ্ঠ এমন বিষাদে ভরা।
বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) শেষ হতে চলেছে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে আয়োজিত তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৩তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে গত মঙ্গলবার এ উৎসব শুরু হয়।
রীতি অনুযায়ী স্মরণোৎসবের দ্বিতীয় দিন দুপুরে পূর্ণসেবা (মধ্যাহ্নভোজ; এক পদের মাছ, পাঁচ রকমের সবজির তরকারি, ডাল, ভাত ও দই) গ্রহণের পর বাউলরা আখড়াবাড়ি ছাড়তে শুরু করেন। এবারের তিথি অনুযায়ী গতকাল বুধবার দুপুরে পূর্ণসেবা নিয়েছেন বাউল সাধুগুরুরা। এরপর তারা একে একে আখড়াবাড়ি ছাড়তে শুরু করেছেন। তবে লালন একাডেমি আয়োজিত উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে আজ বৃহস্পতিবার।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক ফকির লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। এরপর থেকে তার অনুসারী ভক্ত বাউল সাধকরা এ দিনটিকে লালন স্মরণোৎসব হিসেবে পালন শুরু করেন। সেই ধারা আজও ধরে রেখেছেন তার অনুসারী বাউল-বৈষ্ণবরা।
‘চাতক পাখির এমনি ধারা, তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা/অন্য বারি খায় না তারা, মেঘের জল বিনে’- ফকির লালন সাঁইয়ের এই গানে যেমন চাতক পাখির একাগ্রতা ফুটে উঠেছে, তিরোধান দিবসের উৎসবে আসা সহজ মানুষ বাউলদের মধ্যেও তেমনি ধৈর্য ও একাগ্রতার চিত্র চোখে পড়ে গতকাল বিকালে। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে তাদের পূর্ণসেবা পরিবেশন করা হয়। হাজার হাজার বাউলকে খাবার পরিবেশন করতে বিকাল গড়িয়ে যায়। সবার পাতে খাবার পৌঁছানো নিশ্চিত করার পর আখড়াবাড়ি কর্তৃপক্ষ রীতি অনুযায়ী মাইকে তিনবার ‘আল্লাহ আলেক’ ধ্বনি উচ্চারণ করার পরই কেবল সবাই একসঙ্গে খাবার মুখে তোলেন। এর আগে কেউ একদানা খাবারও মুখে তোলেন না। গতকালও এ রীতির ব্যতিক্রম ঘটেনি।
লালন আখড়াবাড়ি সাধকদের কাছে পরম ভক্তির তীর্থস্থান। পূর্ণসেবা নেওয়ার পর বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে থাকা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা প্রবীণ বাউল আলম শাহ বললেন, ‘সাঁইজির চরণ তলে কটা দিন পড়ে ছিলাম। এখন বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে, কিন্তু মন তো চাইছে না বাড়ি ফিরতে। আরও কটা দিন থেকে যেতে পারলে ভালো হতো। মনটা কেমন করছে, আর যদি আসতে না পারি কোনো দিন!’
আরেক বাউল ইসলাম শাহ বললেন, ‘বাড়ি ফিরতে মন চাইছে না বাবা। ভাবছি আরও কটা দিন গুরু ধামে থেকে যাব।’
নারী বাউল করিমন খাতুন জানালেন, ‘বাবা বাড়ি ফিরে যাচ্ছি ঠিকই, মনটা পড়ে রইল আখড়াবাড়িতে। এখন থেকেই ফাল্গুনের দোলউৎসবের প্রহর গুনছি।’
এখানে আগত বাউলরা ভাব পরম্পরা বিনিময় করেন আপন মনে, নিজস্ব রীতিতে। গুরুবাদী এ ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে গুরুই সব। গুরুর নির্দেশিত পথে সাধন-ভজন এবং রস আস্বাদনের সব পথই উন্মুক্ত। আর এই যজ্ঞ সম্পাদনের মধ্য দিয়েই সীমার মাঝে অসীম খুঁজে ফেরেন এই মতে বিশ্বাসীরা।