কুষ্টিয়া প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:২৬ পিএম
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:২৮ পিএম
‘সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে আমরা হিল্লি-দিল্লি ঘুরে বেড়াই। তার সান্নিধ্য পেতে কত পথ, কত মত। কিন্তু মানুষের মাঝেই সৃষ্টিকর্তার বাস। মানুষকে ভালোবাসলেই তাকে পাওয়া যায়। লালন সাঁই তার গানে, তার বাণীতে বারবার সে কথাই তুলে ধরেছেন।’ কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার লালন আখড়াবাড়িতে আসন পেতে বসা প্রবীণ বাউল বীর মুক্তিযোদ্ধা নহির উদ্দিন শাহ।
ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৩তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়াতে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনের লালন স্মরণ উৎসব। বাউল সাধু গুরুদের পদচারণায় এখন মুখর এ বাউল তীর্থ। তিল ধারণের ঠাঁই নেই মরা কালীগঙ্গার তীরের লালন আখড়ায়।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক ফকির লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। এরপর থেকে তার অনুসারী ভক্ত বাউল সাধকরা এদিনটিকে লালন স্মরণ উৎসব হিসেবে পালন শুরু করেন। সেই ধারা আজও ধরে রেখেছেন তার অনুসারী বাউল-বৈষ্ণবরা। এবারের উৎসবে যোগ দিতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার বাউল উৎসব শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই জড়ো হয়েছিলেন ছেঁউড়িয়ার লালন ধামে। নির্লোভ, নিরহংকার, সহজ-সরল এই মানুষগুলো আধুনিক সামাজিক লোকাচারের বাইরে থেকে ঈশ্বরকে পাওয়া আর আত্মশুদ্ধির সাধনা করেন বাউল তীর্থ ছেঁউড়িয়ায় এসে।
ভাবগান আর বাউল আচারের যজ্ঞ পালন ছাড়াও বাউল পথ ও মতের দীক্ষাও নিচ্ছে অনেকে। স্মরণোৎসব মানেই বাউল ফকিরদের মহাসম্মেলন। এখানে আগত বাউলরা ভাবপরম্পরা বিনিময় করেন আপন মনে, নিজস্ব রীতিতে। গুরুবাদী এ ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে গুরুই সব। গুরুর নির্দেশিত পথে সাধন-ভজন এবং রসাস্বাদনের সব পথই উন্মুক্ত। আর এই যজ্ঞ সম্পাদনের মধ্য দিয়েই সীমার মাঝে অসীমকে খুঁজে ফেরে এই মতে বিশ্বাসীরা।
লালন মাজারের আশপাশ ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেন তার গাওয়া গান গেয়ে। ধামের পাশে বিশাল মাঠের খোলা প্রান্তরে গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের সন্ধানে আকুল ভক্তদের চলছে নাচে-গানে দিন-রাত ভাবের খেলা।
বাউল সাধুদের পাশাপাশি আখড়াবাড়ির দোল উৎসবে যোগ দিয়েছে হাজারো দর্শনার্থী। আখড়াবাড়িতে কথা হয় বাগেরহাটের ফকিরহাটের আলিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে এলে মানুষের আলাদা একটা রূপ চোখে পড়ে। মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র শেখা যায়।
ঢাকা থেকে আসা দর্শনার্থী আলম হোসেন ও মেহেরাব হোসেন বলেন, উৎসব দেখতে এসেছি। লোকজনের প্রচুর ভিড়। গান শুনতে ভালো লাগছে। তবে অনুষ্ঠানের সময় খাবার ও আবাসিক হোটেল মালিকরা কয়েকগুণ বেশি টাকা নিচ্ছে। এতে অনেকের সমস্যা হচ্ছে।
একই অভিযোগ আছে অন্যদের। অন্য সময় যেসব হোটেলে সাধারণ মানের কক্ষ ১ হাজার টাকায় পাওয়া যায়, সেটি এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা ও এসি কক্ষ এক লাফে ৪ হাজার টাকায় উঠেছে।
আখড়াবাড়িতে কথা হয় কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাউল ফজল শাহের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সহজ মানুষ খোঁজা আর ভজার কাজে দীক্ষা নিয়েছি। এই পথেই সারা জীবন কাটাতে চাই।’
লালন অনুসারীরা বলেন, তাদের মূল চিন্তায় থাকে মানুষের কল্যাণ কামনা করা, মানুষের মঙ্গল চাওয়া। তাই তো লালন বলে গেছেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। উৎসবের মূল আকর্ষণ থাকে মূলত লালনের গান। এ গান শুনতেই আসেন অনেকে। খালি গলায়, একতারা হাতে গান করেন বেশিরভাগ বাউল।
দেখা গেছে বেশিরভাগ প্রবীণ বাউল বসেছেন একেবারে লালন ফকিরের আখড়ার পাশে। বাউলদের একেকটি পরিবার আস্তানা গেড়েছে। সেখানে মূল যিনি গুরু, তাকে ঘিরে বসেছে নবীনরা। নারীরাও আছে সঙ্গে।
বাউল আশরাফ ফকির বলেন, ‘এ দিন শোকের। আমরা শোক পালন করি। গুরুকে স্মরণ করি তার গানের মাধ্যমে। উৎসবে তাদের দাওয়াতের প্রয়োজন হয় না। মনের মধ্যে আগে থেকেই দিনটি গাঁথা থাকে। তাই তো টানেই চলে আসি।’
লালন গবেষক ড. আজাদুর রহমান বলেন, লালন ফকির ছিলেন সাধক। তিনি এমন এক সমাজ গঠনের চিন্তা করতেন, যেখানে কোনো হানাহানি, মারামারি, হিংসা থাকবে না। মানুষের কল্যাণের বিষয়টি ছিল তার মূল চিন্তার জায়গা। তিনি গানে গানে সমাজের নানা অসঙ্গতির চিত্র যেমন ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তেমনি প্রতিবাদ করেছিলেন নানা অন্যায়ের।’