জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ২২:৫০ পিএম
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ২৩:১২ পিএম
সব পথ এসে যেন মিশেছে ছেঁউড়িয়ায়- লালন আখড়াবাড়িতে। বাউল সাধু বৈষ্ণবদের মেলা বসেছে লালনধামে। ধর্মবর্ণ-জাতপাত ভুলে তারা গাইছেন মানুষের জয়গান। ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’, ‘এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’, ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর সেথা এক পড়শি বসত করে’,-এ রকম অসংখ্য সংগীতের সুরের মূর্ছনায় এখন মাতোয়ারা সাঁইজির বারামখানা। কারণ আখড়াবাড়িতে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব।
এ উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার কথা মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। তবে অনেক আগেই মানুষ আসতে শুরু করেছে এই বাউলধামে। বাউলসম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৩তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে এই বাউলতীর্থে ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণ দর্শনার্থীরাও।
লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করছেন গানে গানে। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও। ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে হাজারো মানুষ সাঁইজির সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন এ স্মরণোৎসবে। আউল-বাউল, সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দিওয়ানাদের পদভারে মুখর হয়ে উঠেছে সাঁইজির ধাম। ধামের পাশে বিশাল মাঠের খোলা প্রান্তরে গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের সন্ধানে আকুল ভক্তরা। চিঠি নেই পত্র নেই, কোন এক অদৃশ্য সুতোর টানে দলে দলে বাউল সাধু গুরুরা ছুটে এসেছেন আখড়াবাড়িতে।
উৎসবের সময় আখড়াবাড়ির আঙিনায় বসার জায়গা না-ও মিলতে পারে; সেজন্য অনুষ্ঠান শুরুর পাঁচ দিন থেকেই এখানে এসে আসন পেতেছেন মেহেরপুরের লালনভক্ত ষাটোর্ধ্ব নিজাম শাহ। আলাপকালে এই প্রবীণ বাউলসাধক বলেন, বছরে দুবার সাঁইজির বারামখানায় সাধু-গুরুদের মিলনমেলা বসে। এ দিনটি এলে কিছুতেই বাড়িতে মন টেকে না। সংসারের সব মায়ার সুতো ছিঁড়ে চলে আসি আখড়াবাড়ি।
৩০ বছর ধরে এভাবেই এখানে চলে আসছেন কলিম শাহও। আরেক বাউল ফকির ইদ্রিস শাহ বলেন, আগে এলে সাঁইজির মাজারের কাছাকাছি বসার জায়গা মেলে। আবার অনেক দিন ধরে এখানে কাটানো যায়। এর যে কী আনন্দ, কী স্বাদ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
বাংলা ১২৯৭ সালের পহেলা কার্তিক ফকির লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। এরপর থেকে তার অনুসারী ভক্ত বাউলসাধকরা এ দিনটিতে তাকে স্মরণ করে আসছেন। লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই উৎসবের কলেবর বেড়েছে। এখন প্রতিবছর এ দিনটিকে ঘিরে লালন আখড়াবাড়িতে বসে তিন দিনের উৎসব। আজ সন্ধ্যায় এ আয়োজনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি। উৎসব চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লালন ভক্ত বাউল সাধু গুরুরা আখড়াবাড়িতে এসে বসেছেন আসন পেতে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা মেতে উঠেছেন গানবাজনা আর তত্ত্বকথার আলোচনায়। একতারা, দোতারাসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের সুরে মুখর হয়ে উঠেছে লালনধান। এ ছাড়া আখড়াবাড়ির বাইরে মরা কালীগঙ্গা নদীর তীরে বসেছে গ্রামীণ মেলা। সেখানে বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।
এ উৎসবকে নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমি সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি এহতেশাম রেজা জানান, উৎসবের তিন দিন ভক্ত বাউলসাধকরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করবেন। করবেন নানা তত্ত্বকথার আলোচনা।