ফাহিম শাহরিয়ার শাফাত, লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:৪৩ পিএম
গ্রামের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার শেখার পাশাপাশি শিখছেন ফ্রিল্যান্সিং। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামে গড়ে ওঠা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান ‘চুনতি লাইট হাউস’। এ প্রতিষ্ঠানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার শেখার পাশাপাশি শিখছেন ফ্রিল্যান্সিং। শুধু তাই নয়, এটি একটি ডিজিটাল লাইব্রেরি ও নলেজ সেন্টারও। যার উদ্দেশ্য চুনতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করা এবং আগামী প্রজন্মকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা, এমএস ওয়ার্ড, অপারেটিং সিস্টেম, হার্ডওয়্যার, ফ্রিল্যান্সিং, কমিউনিকেশন, সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি নানা বিষয়ে পেশাদার শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলছে।
চুনতি লাইট হাউসের আরেকটি অনন্য উদ্যোগ হচ্ছে এতিম মেয়েদের জন্য ‘মরফুয়া ও জেবুন্নেসা বেগম মহিলা এতিমখানা ও ছাত্রীনিবাস’। এখানে ৩০ জন এতিম ছাত্রী বসবাস করে। সাধারণত দেশে ছেলেদের বহু এতিমখানা দেখা যায়। কিন্তু ছেলেদের মতো মেয়ে এতিমও যে রয়েছে এবং তাদের দেখভাল করার জন্যও যে এতিমখানা হতে পারে তার উদাহরণ এ প্রতিষ্ঠানটি। এখান থেকে এতিম মেয়েরা বিনামূল্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি চুনতি লাইট হাউসে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাচ্ছে।
চুনতি লাইট হাউসের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান চুনতি খান ফাউন্ডেশন। এ অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে বহুবিধ জনকল্যাণমুখী মানবিক ও সামাজিক কাজ করছে এ ফাউন্ডেশন। যার মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা, শীতবস্ত্র বিতরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো উন্নয়ন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহায়তা, গ্রামের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী থেকে নারী উদ্যোক্তা তৈরি, সুদবিহীন কৃষিঋণ বিতরণ, বাস্তুহীনদের গৃহ নির্মাণ সহায়তা ইত্যাদি।
সরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানামুখী প্রকল্প হাতে নিলেও এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে নানা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠলেও ব্যয়বহুল হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। দেশে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানার্জনে সহায়ক প্রতিষ্ঠান খুব একটা গড়ে না উঠলেও সাম্প্রতিক সময়ে চুনতি অঞ্চলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় নজর কেড়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে ব্যক্তি উদ্যোগে এমন একটি প্রতিষ্ঠান চালানো দুরূহ হলেও কাজটিতে হাত দিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন চুনতির দুই গুণী ব্যক্তি মাসুদ খান ও তার স্ত্রী মিসেস সুরাইয়া জান্নাত খান।
চুনতি লাইট হাউসের শিক্ষার্থী তাজরিয়ান নূর জুহার বলে, ‘এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বাসায় বেকার সময় কাটাচ্ছিলাম। এই সময় জানতে পারি চুনতি লাইট হাউসে বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাই আমি এখানে ভর্তি হয়ে তিন মাস ক্লাস করি। প্রথমে আমি কম্পিউটার সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা আর্জন করি। ধাপে ধাপে টাইপিং, এমএস ওয়ার্ড, এক্স-এল এবং সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কিং সম্পর্কে দক্ষতা আর্জন করি। লাইট হাউসের জন্যই আজ আমি এতকিছু সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি।’
শিক্ষাবিদ ও লেখিকা সানজিদা রহমান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়াচ্ছে চুনতি লাইট হাউস। দেশের বিভাগীয় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও কম্পিউটার ল্যাব কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা উপকরণ অপ্রতুল। সেখানে প্রত্যন্ত জনপদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা যে কতটা সঙিন তা সহজেই অনুমেয়। অথচ সেই গ্রামীণ জনপদেই গড়ে উঠেছে তথ্য ও প্রযুক্তি শিক্ষাকেন্দ্র চুনতি লাইট হাউস।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন বলেন, আইসিটিতে ব্যাপক অবদান রাখবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। ফ্রিল্যান্সিং শিখে নিজকে যোগ্য করে তুলছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে ৫০ জন শিক্ষার্থীর প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে।
চুনতি লাইট হাউসের নির্বাহী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবিউল হাসান আশিক বলেন, ‘আমাদের যাত্রা সবেমাত্র শুরু হলো, এখনও পথের অনেক বাকি। গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগামীর জন্য গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছে লাইট হাউস। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং দেশ। গ্রামের পশ্চাৎপদ শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা আগামী দিনে তাদের দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। যাতে তারা গ্রামে বসেই আয়-রোজগার করে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং স্ব স্ব পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে। আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তা হলো, তাদের মনের চোখ খুলে দেওয়া। তাদের স্বপ্ন দেখার সাহস দেওয়া। কারণ তাদের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। উপযুক্ত পরিবেশ আর সুযোগ পেলে তারাও দেখিয়ে দিতে পারে সফল হওয়ার সক্ষমতা।’