মেরিনা লাভলী, রংপুর
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪০ পিএম
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:২৩ পিএম
রংপুর নগরীর মীরগঞ্জ এলাকায় বীরকন্যা লালবিবির সমাধি। সম্প্রতি তোলা
ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন মুঘল সম্রাজ্ঞী লালবিবি। ইংরেজদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। পরে তাদের হাতেই নিহত হন। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই বীরকন্যার সমাধি রয়েছে রংপুর নগরীর নগর মীরগঞ্জ এলাকায়। তবে তা অযত্ন-অবহেলায় আজ ধ্বংসের পথে। স্থানীয়দের চাওয়াÑ সমাধিটি সংস্কার করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।
ইতিহাস ও লালবিবির সমাধির সামনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের টাঙানো বোর্ড থেকে জানা যায়, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরবর্তীতে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সমরনায়ক মুঘল শাহজাদা নূর উদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জংয়ের সংগ্রামীকন্যা লালবিবি। তিনি দিল্লির মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের মা ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের স্ত্রী। পলাশী যুদ্ধের সময়কালে দিল্লির মুঘল সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় আলমগীর। নবাব সিরাজদৌলার মৃত্যুর খবর পেয়ে সম্রাট তার জামাতা নূর উদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জংকে মুঘল প্রতিনিধি ও বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে রংপুরের মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি নামক স্থানে এসে রাজধানীর গোড়াপত্তন করেন।
সেখানকার জগদীশপুরের জমিদার রাজা দয়ালশীল তার দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাজা দয়াশীল তার রাজপ্রাসাদ নুর উদ্দিনকে ছেড়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তী ময়েনপুরের কদমতলায় চলে যান। বাকের জংয়ের পূর্বপুরুষরা ১৬৮৭ সালে রংপুরে আসে। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। বড় মেয়ে লালবিবি ও ছোট চাঁদবিবি। ছিয়াত্তরের মনন্তর এবং প্রজাবিদ্রোহের সময় বাকের জং ইংরেজবিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। এ সময় তাকে বিভিন্ন অঞ্চলে ছদ্মাবেশে ঘেরাফেরা করতে হতো। তিনি বৃহত্তর রংপুরের ইংরেজবিদ্রোহের প্রধান নায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তার বীরত্বপূর্ণ জীবনের শেষদিকে মুঘলহাট যুদ্ধে ম্যাকডোনাল্ড ও তার বাহিনীর প্রতারণার কারণে ১৭৮৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাকের জং নিহত হন। বর্তমানে মিঠাপুকুরে তার সমাধি রয়েছে।
এদিকে ভারতবর্ষে ইংরেজদের ক্ষমতা লাভের ফলে ভয় পেয়ে মুঘল সম্রাট ও তার ছেলে দ্বিতীয় আকবর তাদের সঙ্গে সন্ধি করেন। পরে লালবিবির।
ছোট ভাই কামাল উদ্দিন মোহাম্মদও সন্ধি করেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর ইংরেজরা দিল্লির সম্রাটের উপাধি বিলুপ্ত করে। দিল্লির শাহি বালাখানা থেকে সম্রাটের পরিবার-পরিজনদের বের করে দেয়। ১৮৩২ থেকে ১৮৩৪ সালে স্বামীর আজাদী রক্ষার জন্য লালবিবি গোপনে রংপুরে পিত্রালয়ে ফুলচৌকিতে আসেন। পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ, জনমত গঠন ও বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী তৈরির মাধ্যমে ইংরেজদের পরাজিত করে আবারও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি গোপনে প্রজাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ইংরেজ গুপ্তচর বাহিনীর অপতৎপরতা শুরু করে। লালবিবির বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা বড় বড় শহরে ও সম্ভ্রান্ত বাড়িতে খোঁজ করতে থাকে ‘কাহা লালবিবি, কাহা লালবিবি’।
১৮৭৩ সালের দিকে লালবিবি ও সেনানায়ক ভবানী পাঠকসহ অন্যরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য ফুলচৌকি নগর থেকে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ইংরেজবিরোধী নেতা মরিচানন্দ গীরিধরের সঙ্গে আলোচনা করার লক্ষ্যে মাহিগঞ্জে আসতে থাকেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সেনানায়ক অকল্যান্ডের নেতৃত্বে ইংরেজ সৈন্যরা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে লালবিবি ও ভবানী পাঠক নিহত হন। পরে তাকে নগর মীরগঞ্জের একটি দিঘির পাড়ে সমাহিত করা হয়।
জানা গেছে, লালবিবি ও ভবানী পাঠককে হত্যার কাজে সহযোগিতা করার পুরস্কার হিসেবে তৎকালীন পায়রাবন্দের টাটি শেখ, খয়ের উদ্দিন প্রামাণিক ও জনৈক লাহিড়ীকে ৬০ লাখ টাকা অধিক মূল্যমানের জমিদারি দান করে ব্রিটিশরা। পরবর্তীতে লালবিবির ভাই কামাল উদ্দিন মোহাম্মদ ও জামাল উদ্দিন মোহাম্মদ তার কবরটি পাকা করে দেন। ইতিহাস লেখক আবুল কাশেমের মুর্শিদাবাদ থেকে রংপুর, হায়দার আলী চৌধুরীর পলাশী যুদ্ধোত্তর আজাদী সংগ্রামের পাদপীঠ, মতিউর রহমান বসুনিয়ার কিংবদন্তির রংপুর বইয়ে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
নগরীর মাহিগঞ্জের শিক্ষক হাসেম আলী বলেন, বাকের জং এবং তার মেয়ে লালবিবির বীরত্বের ইতিহাস অন্যায়-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জোগায়। ইংরেজ দখলদারিত্ব থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে তাদের অবদান গর্বের। অথচ অযত্নে লালবিবির সমাধি আজ ধ্বংসের পথে।
রংপুর প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব লেখক জাকির আহমদ বলেন, লালবিবির সমাধি সংরক্ষণে কয়েক বছর আগে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এরপর মন্ত্রণালয় এটিকে সংরক্ষিত পুরার্কীতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এবং সমাধির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এরপরও লালবিবির সমাধিস্থল অবহেলিতই রয়েছে। আমরা চাই সমাধিটি সংরক্ষণ করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।
রংপুর জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান বলেন, লালবিবির সমাধি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরার্কীতি। এটির সংস্কারের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।