পঞ্চগড়ে নৌকাডুবি
পঞ্চগড় প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:২১ এএম
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৩৬ এএম
পঞ্চগড়ের বোদায় নৌকাডুবির ঘটনায় আরও একজন নিখোঁজ রয়েছেন। ফাইল ছবি
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় ভয়াল নৌকাডুবির এক বছর পূর্ণ হলো আজ (২৫ সেপ্টেম্বর)। ২০২২ সালের এই দিনে উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে শতাধিক মানুষ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় করে বদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৭২ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে একজনের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্বজন হারানোর বেদনা আজও নাড়া দেয় পরিবারের সদস্যদের। পরিবারপ্রধান বা উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার। অভিযোগ সেসব পরিবারের খোঁজখবর রাখছেন না কেউ। এ ছাড়া ঘটনার প্রকৃত দোষীদের আড়াল করে নিরীহ নৌশ্রমিককে ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে। সেদিনের দুর্বিষহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় বেঁচে ফেরাদের।
নৌকাডুবিতে উপজেলার বটতলী এলাকার উজ্জল কুমার রায় মা-বাবাসহ পরিবারের ৬ সদস্যকে হারান। স্বজন হারানোর ব্যথা আজও নাড়া দেয় তাদের। বাবা মায়ের কথা মনে হলেই ছবিতে হাত বুলিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেন উজ্জল। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘দায়িত্বরতদের অবহেলায় সেদিন বাবা -মা, পিসি, মাসি, নানা ও নানার বেয়াইকে হারিয়েছি। যারা নদীর ঘাটে ছিলেন তারা সতর্ক হলে এমন ঘটনা না-ও ঘটাতে পারত। এক বছর পার হয়ে গেল তারা নেই। ভাইসহ নিজের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের খরচ, কৃষিকাজ সবই দেখতে হয় আমাকে। অনেক টাকা বায় হচ্ছে, এত টাকা কীভাবে জোগাড় করব। জীবনের লক্ষ্য থেকে সরে গেছি। সামনের দিনে কীভাবে চলব সেই ভেবে কূলকিনারা পাই না।’
পরিবারের প্রধানকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন একই এলাকার গৃহবধূ ফুলমতি রাণী। এখন নিজেই ধরেছেন পরিবারের হাল। তার দুই সন্তান আজও খোঁজে বাবাকে। দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন ফুলমতি। স্বামীর ছবি হাতে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন, সান্ত্বনা খোঁজেন। ফুলমতি রাণী বলেন, ‘অকালে স্বামী হারিয়ে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেছি। ছোট্ট মেয়েটা এখনও রাতে কেঁদে কেঁদে তার বাবাকে খোঁজে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে বাবা আমার জন্য বাজার থেকে খাবার আনতে গেছে। এমন কথা শুনলে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। দুই সন্তান আর শাশুড়িকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। কীভাবে সংসার চালাচ্ছি, কেমন আছি- গত এক বছরে কেউ খোঁজ নেয়নি, কেউ দেখতেও আসেনি।’
নৌকাডুবির ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। দুর্ঘটনার ৫৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় এক শিশুর মরদেহ। তবে এক বছরেও মরদেহের খোঁজ মেলেনি ডাঙ্গাপাড়া এলাকার সরেন্দ্রনাথ রায় নামে এক বৃদ্ধের।
নিখোঁজ স্বামী সরেন্দ্রনাথ রায়ের ছবি নিয়ে আজও বিলাপ করেন ডাঙ্গাপাড়া এলাকার শান্তি রাণী। শান্তি রাণী বলেন, ‘মানুষটা সেদিন দুপুরে সাইকেল নিয়ে বেয়াইসহ মহালয়ার অনুষ্ঠানে গেলেন। পরে বিকালে শুনতে পাই নৌকাডুবি হয়েছে। তিনি হয়তো দূরের পথ ঘুরে বাড়ি ফিরছেন এই আশায় ছিলাম। কিন্তু এক দিন, দুই দিন- এক বছর হয়ে গেল, আজও ফিরে পেলাম না।’
নৌকাডুবির ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরেন মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের সর্দারপাড়া এলাকার ইশিতা কলি রায় ও দর্প নারায়ণ নামে দুই ভাইবোন। সেদিনের কথা মনে হলে আজও আঁতকে ওঠেন তারা। ইশিতা বলেন, ‘সেদিন ছোট ভাইসহ মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝপথে নৌকাডুবি হলে পানিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে ছোট ভাই সাঁতরে নদীর পাড়ে নিয়ে আসে। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেদিনের ঘটনা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে, ভয়ে আঁতকে উঠি।’
নৌকাডুবির ঘটনায় ঘাট ইজারাদার জব্বারসহ তিনজনকে আসামি করে গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিশেষ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২-এ মামলা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ১৪ মার্চ ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার ও নৌকার শ্রমিক বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে বোদা থানার পুলিশ। মামলার অন্য আসামি নৌকার মাঝি রবিউল ইসলাম পলাতক রয়েছেন।
নৌশ্রমিক বাচ্চু মিয়ার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে বাচ্চু মিয়াকে ফাঁসানো হয়েছে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকায় পাঁচ সন্তানকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন স্ত্রী জয়গুন আক্তার। তিনি বলেন, ‘পাঁচ সন্তানরে নিয়া খুব কষ্টে দিন কাটাই। বড় ছেলে পড়াশোনা বাদ দিয়া বাজারে একটা দোকানে ১৫০ টাকা হাজিরায় কাজ করে। তা দিয়ে কোনোমতে চলছি। অসুস্থতায় তেমন কোনো কাজ করতে পারি না।’
জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘নৌকাডুবির পরে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। নিহতদের পরিবারের সদস্যদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি তাদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি।’