সালথা-নগরকান্দা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৪ পিএম
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:২৯ এএম
অসচ্ছল কৃষকদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনার টাকার চেক সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও সচ্ছল ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ। প্রবা ফটো
ফরিদপুরের সালথা-নগরকান্দায় পানির অভাবে পাট জাগ দেওয়া নিয়ে বিপাকে পড়া অসচ্ছল কৃষকদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনার টাকার চেক সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও সচ্ছল ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন অসচ্ছল প্রান্তিক কৃষকরা। কৃষকদের দাবি, পাট অধিদপ্তরের কৃষি প্রণোদনার খবর তারা জানেনই না। তাদের অভিযোগ পাট অফিসের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা যোগসাজশে প্রণোদনার এই টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
এবার ভরা মৌসুমে নদ-নদী ও খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি না হওয়ায় পাট পচাতে বাড়তি খরচ বিবেচনায় পাট অধিদপ্তর পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে অসচ্ছল কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সালথা-নগরকান্দার ১৬ জন অসচ্ছল কৃষককে ১১ হাজার ৮০০ টাকার একেকটি চেক বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ কৃষকই জানেন না এই প্রণোদনার কথা।
চেক বিতরণের তালিকায় দেখা যায়, সালথার আটজন অসচ্ছল কৃষকের স্থলে চেক গ্রহণ করেছেন সালথা উপজেলা পরিষদের অফিস সহায়ক শাহাদত হোসেন, রামকান্তুপুর গ্রামের গরুর খামারি হাফিজুর রহমান, একই গ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান এমেলি, ফুকরা বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন, রামকান্তুপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী মোক্তার মোল্যা, ইব্রাহিম হোসেন ও যদুনন্দী ইউনিয়নের মো. আবুল হাসান।
সালথা উপজেলার আটঘর ইউনিয়নের বিভাগদী গ্রামের কৃষক মজিবর সরদার বলেন, পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারিনি। নোংরা পানিতে পাট জাগ দেওয়ায় এর রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেকের পাট ক্ষেতেই শুকিয়ে মরে গেছে। এবার এক বিঘা জমিতে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ মণ পাট হয়েছে। প্রতিবিঘায় খরচ হয়েছে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা করে। এমন অবস্থায় পাটের যে দাম পাচ্ছি তাতে আমাদের খরচই উঠছে না। তিনি আরও বলেন, পাট অধিদপ্তর থেকে আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কোনো ধরনের প্রণোদনা পাননি। এমনকি এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।
সালথা উপজেলা পরিষদের অফিস সহায়ক সোনাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরির পাশাপাশি বাড়িতে কৃষিকাজ করি। আমার বাবার কৃষিজমি আছে। আমি ৫০ শতাংশ জমিতে পাট বুনেছি। আমার বাড়ির সামনে গর্ত করে মেশিন দিয়ে পানি দিয়ে পাট পচাইছি। আমি পাট অফিসের কর্মকর্তাকে বলেছিলাম এবার পাটের খরচ অনেক বেশি, দামে তো খরচ ওঠে না। তখন কর্মকর্তা বলেছিলেন, আমরা পাটের প্রণোদনা দেব, দেখি তখন আপনাকে দেওয়া যায় কি না।’
নগরকান্দার তালিকায় চরযোশরদী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ইমারত হোসেন দুলাল, রামনগর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. হারেজ প্রামাণিক, ছরোয়ার ও গিয়াসউদ্দীন। ডাঙ্গি ইউনিয়নের রাশেদ মোল্যা, ইকরাম সরদার, তালমা ইউনিয়নের মজনু ফকির ও ইকরাম ফকির। এই তালিকায় আরও তিনজনের নাম কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। রামনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হারেজ প্রামাণিক বলেন, ‘আমি একজন ব্যবসায়ী ও বর্তমান মেম্বার। ৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। তাই সরকার আমাকে প্রণোদনা দিয়েছে।’
সালথা উপজেলা উপসহকারী পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল বারী বলেন, এবার যাদের পাটের প্রণোদনা দিয়েছি তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। এরা সবাই ওই সময় গর্ত খুঁড়ে মেশিন দিয়ে পানি ভরে পাট জাগ দিয়েছিল। আমি নিজে যাচাই-বাছাই করে প্রণোদনার তালিকা করেছি। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি।
নগরকান্দা উপজেলা উপসহকারী পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের কাছে অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
নগরকান্দা উপসহকারী পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে অসচ্ছল কৃষকের বদলে সচ্ছল কৃষককে প্রণোদনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘সবাই কৃষক। ইউপি মেম্বার জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধি, আমার কাছে না, তিনি আমার কাছে কৃষক। একজন পাটচাষি। চাষি ধনী-গরিব সব শ্রেণিতেই আছে।’
গরিব কৃষককে না দিয়ে ধনী কৃষককে কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো অনিয়ম এখানে বলা হয়নি। বলা হয়েছে কৃষক হতে হবে।’
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বালী বলেন, ‘আমি এখানে যোগদানের পূর্বেই তালিকা তৈরি হয়েছে। তারপরও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে আমরা তাদের ব্যাপারে তদন্ত করব। তারা কৃষক না হলে, এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ফরিদপুর জেলা পাট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষক নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। আমি এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’