তরিকুল ইসলাম মিঠু, যশোর
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:০৭ পিএম
বেনাপোল স্থলবন্দর, যশোর। ছবি : সংগৃহীত
দেশের প্রধান স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোল, এখানে যাত্রীদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। ফলে দিন দিন কমছে ভারতগামী যাত্রীর সংখ্যা। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বেনাপোল ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলসীমান্ত ব্যবহার করেন ভারতগামী প্রায় ৮০ শতাংশ যাত্রী। প্রতিদিন বেনাপোল ইমিগ্রেশন দিয়ে প্রায় ৬ হাজার যাত্রী ভারতে প্রবেশ করেন।
যাত্রীদের ভারতীয় ভিসা বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে, ভ্রমণকর বৃদ্ধি, বেনাপোল কাস্টমস, বন্দর, ইমিগ্রেশন, আনসার, ইমিগ্রেশনের দালাল, পরিবহন শ্রমিক, ইমিগ্রেশনে কুলি ও ভারতের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনের বিএসএফ ও কাস্টমসের কর্মকর্তাদের হয়রানি, পরিবহনভাড়া বৃদ্ধি, কলকাতায় ও বেনাপোল আবাসিক হোটেল, খাবার হোটেলসহ ঘাটে ঘাটে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এ কারণে ভারতগামী যাত্রীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে সরকার এ খাত থেকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।
ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ মাসে বেনাপোল ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৭৬৪ বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ভারতে গিয়েছেন। আর ভারত থেকে ফিরে এসেছেন ৩ লাখ ৯৪ হাজার ২২৭ জন। একই সময়ে ভারতীয় পাসপোর্টধারী এসেছেন ৮২ হাজার ৮৯৮। আর ভারতে ফিরে গেছেন ৮৩ হাজার ৩৯৮ জন। সব মিলিয়ে ৫ লাখ ১৪ হাজার ১৬২ যাত্রী বেনাপোল ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে আসা-যাওয়া করেছেন। তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা।
ভারতীয় পাসপোর্টধারী যাত্রী এপ্রিল, মে, জুন-এই তিন মাসে দেশে ফিরে গেছেন ৫২ হাজার ৭৬৫ জন। প্রতিজন ৫০০ টাকা হারে ভ্রমণ ট্যাক্স দিয়েছেন ২ কোটি ৬৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। পরবর্তী সময়ে জুলাই, আগস্ট ও ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গিয়েছেন ৩০ হাজার ৬৩৩ জন। প্রতিজন এক হাজার টাকা হারে ভ্রমণ ট্যাক্স দিয়েছেন ৩ কোটি ৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ভারতীয় পাসপোর্টধারী দেশে মোট ভ্রমণ ট্যাক্স দিয়েছেন ৫ কোটি ৭০ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা।
অন্যদিকে গত এপ্রিল, মে, জুনÑ এই তিন মাসে ভারতে গিয়েছেন, ২ লাখ ৪০ হাজার ৪২৮ ব্যক্তি। প্রতিজন ৫০০ টাকা হারে ভ্রমণ ট্যাক্স দিয়েছেন ১২ কোটি ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা। পরবর্তী সমযে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ভারতে গিয়েছেন ১ লাখ ৯০ হাজার ৩৩৬ ব্যক্তি। ভ্রমণ ট্যাক্স বৃদ্ধি করায় প্রতিজন এক হাজার টাকা হারে দিয়েছেন ১৯ কোটি ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
প্রায় ছয় মাসে সর্বমোট ট্যাক্স দিয়েছেন ৩১ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল পাস থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ আয় করেছে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯০৪ টাকা। অন্যদিকে এসব যাত্রী থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে ৮ টাকা হারে ৪১ লাখ ১৩ হাজার ২৯৬ টাকা আদায় করেছে বলে অভিযোগ। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জুলাই মাসের পর থেকে ভারতগামী যাত্রীদের গমনাগমন কমে গেছে। একইভাবে ভারতের পাসপোর্টধারীও বাংলাদেশে আসা কমিয়ে দিয়েছেন। গত অর্থবছর বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২১ লাখ ২৯ হাজার ৬৯৩ জন পাসপোর্টধারী যাত্রী ভারতে যাতায়াত করেছেন। এসব যাত্রীর ৫০০ টাকা হারে ভ্রমণ ট্যাক্স বাবদ সরকার রাজস্ব পেয়েছে শত কোটি টাকার অধিক। কিন্তু এক হাজার টাকা করার পরে সে রাজস্ব তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
আবুল হোসেন নামে একজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘ইমিগ্রেশন কাস্টমসের কর্মকর্তারা ব্যাগেজ রুলের অজুহাত দেখিয়ে যাত্রীর সঙ্গে থাকা অধিকাংশ মালামাল নিয়ে যাচ্ছেন। এসব মালামালের ওপরে ৩০০ শতাং ট্যাক্স বসিয়ে দিচ্ছে। পরে এসব মালামাল কাস্টমসের কর্মকর্তারা দালালের মাধ্যমে বাইরে বিক্রি করছেন। এমনকি ডিএম (কাস্টমস আটক করা পণ্যের রসিদ) করা মালামাল পরে নিতে গেলেও আর পাওয়া যায় না। কর্মকর্তারা সেসব মালামাল বিক্রি করে সেখানে পুরাতন নষ্ট মালামাল ঢুকিয়ে রাখেন।’
আজিজুর রহমান নামে আরেকজন বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর ঢাকা থেকে বেনাপোলের দূরত্ব কমেছে ৭১ কিলোমিটার। কিন্তু বাসভাড়া এক টাকাও কমেনি। বরং বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ভারতেও প্রতিটি পদে পদে হয়রানি বেড়েছে। পেট্রাপোল থেকে কলকাতার ২৫০ রুপির বাসভাড়া ৩৫০ রুপি করা হয়েছে। পেট্রাপোল থেকে বনগাঁর ২৫ রুপির অটো ভাড়া বেড়ে ৫০ রুপি হয়েছে। হোটেলভাড়াও বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। সঙ্গে আছে অসৌজন্যমূলক আচরণও। এসব অমানবিক আচরণের কারণে ভারতে যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি।
দিদারুল আলম নামে আরেকজন বলেন, ‘ভারতে প্রবেশের সময়ে বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ নানা অজুহাত মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। না দিতে পারলে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ইমিগ্রেশনের কয়েকজন চিহ্নিত দালাল পুলিশের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এমনকি তারা পুলিশের চা-পানি নিয়ে আসাসহ যাবতীয় কাজ করে। তাদের মাধ্যমেই এসব টাকা নিয়ে থাকে পুলিশ।’
ভারতগামী যাত্রী কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল ইমিগ্রেশনের অফিসার ইনচার্জ কামরুজ্জামান বলেন, ‘ট্রাভেল টোকেনের মূল্যবৃদ্ধি ও ভারতে নানা বিড়ম্বনার কারণে যাত্রী কমে যাচ্ছে। বেনাপোল ইমিগ্রেশনে যাত্রীকে অহেতুক কোনো অফিসারের হয়রানির অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হয়রানির বিষয়ে জানতে বেনাপোল কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার সাফায়েত হোসেনের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। কল রিসিভ করেননি কমিশনার আব্দুল হাকিমও।
বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিলের কাছে প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল পাসের সময়ে অতিরিক্ত ৮ টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয়। তাই অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি ব্যাংকের লোকজনই বলতে পারবেন।’
সোনালী ব্যাংকের বেনাপোল শাখার ব্যবস্থাপক মহাসীন আলী বলেন, ‘ব্যাংকের কোনো স্টাফ এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’