× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভূমি অধিকার

সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ জন্মভূমিতেও পরবাসী

টাঙ্গাইল প্রতিবেদক

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:০৫ এএম

নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আদর্শ ও ভিটেমাটি টিকিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে আদিবাসীরা। টাঙ্গাইলের মধুপুরে। প্রবা ফটো

নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আদর্শ ও ভিটেমাটি টিকিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে আদিবাসীরা। টাঙ্গাইলের মধুপুরে। প্রবা ফটো

ভূমি অধিকার নিশ্চিত না হওয়ায় দীর্ঘদিন সংখ্যালঘু জাতিসত্তারা ভূমিহীন হয়ে জীবনযাপন করছে। স্থানীয়দের দখলবাজি, সংশ্লিষ্টদের অনিচ্ছা-অনাগ্রহে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের নামে থাকা জমির কাগজপত্র হয়নি। ফলে উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন কাটছে আদিবাসীদের। তাই ভূমি অধিকার নিশ্চিতের দাবি টাঙ্গাইলের মধুপুরের আদিবাসীদের। স্বাধীনতার পর ৫২ বছর কেটে গেলেও তাদের এ দাবির প্রতি বেখেয়াল সংশ্লিষ্টরা। আর কত বছর গেলে নিজেদের মতো করে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারবে, তাদের জানা নেই। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আদর্শ ও ভিটেমাটি টিকিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে এখানকার আদিবাসীরা। এই আধুনিক যুগে এসেও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ তাদের নিজস্ব জগৎ, বসতভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার স্থাপন করতে পারেনি। 

বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের বসবাস। তাদের সিংহভাগ জনগণ এখনও জীবিকা নির্বাহের জন্য ভূমি ও বনের ওপর নির্ভরশীল। টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় অঞ্চলের উপজেলার ১৩টি গ্রামে গারোরা বহু আগে থেকেই বসবাস করে আসছে। স্মরণাতীত কাল থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভূমিতে বসবাস করছে। মধুপুরের গড়কে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করায় এ অঞ্চলের গারোরা উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে। পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়তে নারাজ তারা। বরং তারা বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হতে চায়। জমির খাজনা পরিশোধ করে বুঝে নিতে চায় তাদের দখলে থাকা ভূমি। কিন্তু না দিতে পারছে খাজনা, না পারছে জমির কাগজপত্র সংশোধন করতে। বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করলে কোথায় উঠবে, এ নিয়ে রয়েছে শঙ্কায়। 

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক গেজেটের মাধ্যমে মধুপুর গড় এলাকার ৯ হাজার ১৪৫ একর জমিকে চূড়ান্তভাবে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করে। এই জমিগুলোর মধ্যেই গারো ও কোচদের গায়রা, জলই, টেলকি, সাধুপাড়া, জালাবাদা, কাকড়াগুনি, বেদুরিয়া, জয়নাগাছা, বন্দরিয়া, কেজাই, আমলীতলা পনামারি ও গাছাবাড়ি এই ১৩টি গ্রাম পড়েছে। এসব গ্রামের ১ হাজার ৮৩টি গারো ও কোচ পরিবারের ৬ হাজার ৭৭ জনের বসতবাড়ি এবং তাদের আড়াই হাজার একর চাষাবাদের জমি রয়েছে। মোট লোকসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ২০০ জন। কয়েক পুরুষ থেকে বসবাস করা এসব মানুষ এখন উচ্ছেদ-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তবে মধুপুর গড়কে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হলে কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে, তার সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি মধুপুর বন বিভাগ।

সংখ্যালঘু জাতিসত্তা তাদের নিজস্ব আইনে চলে। তাদের আইন অনুযায়ী ভূমির মালিকানার কোনো লিখিত কাগজের রেওয়াজ নেই। এ কারণেই তাদের অনেক ভূমিই বাঙালিরা দখল করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সরকার আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ র‌্যাটিফাই করে। এ কনভেনশনে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ঐতিহ্যগত ভূমির মালিকানা ও অধিকার স্বীকৃত। আইএলও কনভেনশনের মূল কথাÑ এসব জাতিগোষ্ঠীর দলিল থাকুক বা না থাকুক, যে জমি ঐতিহ্যগতভাবে তারা ব্যবহার করে, সে জমি তাদের। বাংলাদেশ সরকার আইএলও কনভেনশন ১০৭-এ অনুস্বাক্ষর করেছে। সুতরাং সে অর্থে কাগজবিহীন সমষ্টিগত ভূমি মালিকানার বিষয়টি দেশের আইনে পরিণত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু এ কনভেনশনের আলোকে জাতীয় পর্যায়ে আইন বা নীতিমালা হয়নি এখনও।

এদিকে এই বনে ‘ইকো টুরিজম’ এলাকা ঘোষণার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বন বিভাগ। এটি বাস্তবায়িত হলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের ভূমি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পনা বাতিলসহ গারো ও কোচদের রেকর্ডভুক্ত জমির নিয়মিত খাজনা নেওয়া চালু করার দাবি জানান তারা। 

অরণখোলা মৌজার প্রকাশ চন্দ্র ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছেন। তারপর থেকে যোগীন্দ্রনাথ বাহাদুর রাজার কাছে চাং নিয়ে ৩৫০ শতাংশ জমি ভোগ দখল করছেন। বর্তমানে তিনি খাজনা দিতে পারছেন না। পুরোনো কাগজপত্রই তাদের সম্বল। স্থায়ী কাগজপত্র তৈরি করতে পারছেন না তারা। নিষেধাজ্ঞা থাকায় পাকা কোনো ঘরও তুলতে পারছেন না তাদের দখলে থাকা জমিতে।

অরণখোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যার প্রবীর নকরেক জানান, তার বাবা জ্ঞানেন্দ্র নকরেকের নামে ৮১ শতাংশ জমি রয়েছে। তারাও একই সমস্যায় ভুগছেন। নতুন ঘর তৈরি করতে পারছেন না। যেকোনো সময় উচ্ছেদ হওয়ার শঙ্কার কথাও জানান তিনি। 

অজয় এমরি নামের এক বৃদ্ধার দখলে রয়েছে ১ একর ২০ শতাংশ জমি। ভোগদখলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে যেকোনো সময় উচ্ছেদ হতে পারেন বলে আতঙ্ক অজয়ের মধ্যে। থাকছেন মাটির ঘরে। নতুন ঘর তুলতে পারছেন না। ভূমি অফিস খাজনাও নিচ্ছে না। 

অজয় এমরি বলেন, কয়েক পুরুষের জমি সরকার তাদের ভোগদখলে দিলেও ১৯৮৪ সালে কোনো শুনানি ছাড়াই তাদের জমি ছেড়ে দেওয়ার প্রাথমিক নোটিস আসে। এরপর ২০১৬ সালে চূড়ান্ত নোটিস হয়। তারপর থেকে এখনও তারা উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন।

পিরগাছা গ্রামের শিখা চিসিম বলেন, জমি ভোগদখলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তাদের। তবে যেকোনো সময় উচ্ছেদ হতে পারে বলে আতঙ্কে রয়েছেন। নতুন ঘর তুলতে পারছেন না। থাকছেন মাটির ঘরে। ভূমি অফিস খাজনাও নিচ্ছে না। 

পিরগাছা গ্রামের কৌশলা নকরেক বলেন, ‘আমরা পাহাড় জঙ্গলে থাকি। আমাদের কোনো ভূমি অধিকার নেই। আমরা ভূমি অধিকার নিয়েই আন্দোলন করি। সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। সামন্য একটু জমিতে ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করি। এটুকু জমিও যদি সরকার নিয়ে যায়, আমরা কোথায় যাব?’ 

বাগাছাস কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জনজেত্রী বলেন, যে পর্যন্ত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের ভূমি স্বীকৃতি না দেওয়া হবে সে পর্যন্ত সমস্যা থেকেই যাবে। এই ভূমিকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন-জীবিকা। তাদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়া হলে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে। তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভূমি অধিকার নিশ্চিত করাটাই সরকারের কাছে তাদের প্রাণের দাবি। 

জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মি. ইউজিন নকরেক বলেন, এখানকার সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষরা চাষাবাদ করে খায়। নানা সময় এখানে বিভিন্ন প্রকল্প আসে। আর এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা আমাদের উচ্ছেদ করতে চায়। উচ্ছেদ আতঙ্কে তারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আইন করে ভূমির সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন।

অরণখোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহিম বলেন, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষেরা বংশপরম্পরায় দীর্ঘদিন এখানে বসবাস এবং ভূমি অধিকারের জন্য আন্দোলন করে আসছে। এটা তাদের যৌক্তিক আন্দোলন। আমি তাদের এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করছি এবং তারা তাদের ভূমি ফিরে পাক, সেটা প্রত্যাশা করছি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা