শরীয়তপুর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:৪৯ এএম
গুদাম ও ক্লাবঘরকে মাদ্রাসা দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করেন মাদ্রাসা সভাপতি। শরীয়তপুরের নাড়িয়ার মাঝিরহাট এলাকায়। প্রবা ফটো
মাদ্রাসা ভবনের অস্তিত্ব না থাকলেও একটি গুদামঘর ও একটি ক্লাবঘরকে মাদ্রাসার ভবন দেখিয়ে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ প্রকল্পের ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫৮ টাকা আত্মসাতের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী চক্র। এরই মধ্যে চক্রটির হাতে পৌঁছেছে অধিগ্রহণের ৮ ধারার নোটিস। এবার শুধু টাকা পাওয়ার অপেক্ষা। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝিরহাট এলাকায়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে ও সরেজমিনে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা প্রান্ত থেকে জেলা শহর পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার এলাকায় ১৬৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে শরীয়তপুর-জাজিরা ও নাওডোবা পদ্মাব্রিজ অ্যাপ্রোচ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের জন্য সড়ক বিভাগের প্রস্তাবনায় এলএকেস-এর মাধ্যমে জমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ এবং বন বিভাগ যৌথ তদন্ত শেষ করে ৭ ধারার নোটিস প্রদান করে জমি ও স্থাপনার মালিকদের।
নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝিরহাট এলাকায় প্রকল্পে স্থাবর ভূমি অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত বিআরএস ২৩ নম্বর নশাসন মৌজার ৬ নম্বর খতিয়ানের ৩৩০৩, ৩৩০৪ ও ৩৩০৫ নম্বর দাগে ৩৪ শতাংশ জমি অস্তিত্বহীন একটি মাদ্রাসার নামে বিআরএস রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসার ওই রেকর্ডীয় সম্পত্তির ৩৩০৫ নম্বর দাগসহ আরও কয়েকটি দাগের সম্পত্তি এসএ রেকর্ড অনুযায়ী পৈতৃক মালিকানা দাবি করে ২০১৯ সালে স্থানীয় আব্দুল খালেক ব্যাপারী জেলা প্রশাসক ও অস্তিত্বহীন মাদ্রাসাসহ পাঁচজনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। খালেক ব্যাপারীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী নিলুফা বেগম মামলাটি পরিচালনা করছেন।
জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রদত্ত ৮ ধারার নোটিসে মাদ্রাসার নামে স্থাপনা হিসেবে দেখানো হয়েছে ৩৩০৫ নম্বর দাগের একটি ক্লাবঘর। কিন্তু ক্লাবের নিজস্ব মালিকানা দলিল থাকলেও ক্লাব কর্তৃপক্ষ নোটিস পায়নি। ক্লাবঘরের দক্ষিণ পাশের বাগানের জমির মালিক আব্দুল খালেক ব্যাপারীও নোটিস পাননি। ব্যাপারীর বাগানের পাশে জলিল মাঝির একটি গুদামঘর। প্রদত্ত নোটিসে গুদামঘরটিও মাদ্রাসার নামে দেখানো হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ সরদার (৮০) বলেন, ‘৫০ বছর আগে কয়েকজন বাচ্চাকে মক্তবে পড়তে দেখলেও এখানে কোনো মাদ্রাসা ছিল না। আমার জানা মতে এ জায়গা মৃত খালেক ব্যাপারীর।’
স্থানীয় বাসিন্দা মোসলেম ঢালী (৯০) বলেন, আমি এখানে কোনোদিন কোনো মাদ্রাসা দেখিনি। এখানে মাদ্রাসার নামে ঘরের বরাদ্দ কীভাবে হলো তা সংশ্লিষ্টরাই জানেন।
জলিল মাঝির মেয়ে লায়লা জিয়াসমিন বলেন, ‘গুদামঘরটির মালিক আমরা। গ্রামে না থাকার সুযোগে ঘরটি মাদ্রাসার নামে দেখানো হয়েছে।’
মৃত খালেক ব্যাপারীর স্ত্রী নিলুফা বেগম বলেন, ‘৩৩০৫ নম্বর দাগের জমিতে নশাসন ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নামে কোনো মাদ্রাসার ঘর নেই। ওই দাগের জায়গাটি আমার স্বামীর নামে। জায়গাটি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান, যা আমি পরিচালনা করছি।’
ইবতেদায়ি স্বাতন্ত্র্য মাদ্রাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক চুন্নু মাঝি বলেন, ‘গোলাম মোস্তফা মাঝি আমাকে ইবতেদায়ি স্বাতন্ত্র্য মাদ্রাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক করেছেন বলে জানিয়েছেন। আমরা দুজন ছাড়া এই কমিটির অন্য কোনো সদস্য আছে বলে আমার জানা নেই।’
ইবতেদায়ি স্বাতন্ত্র্য মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি দাবি করা গোলাম মোস্তফা মাঝি বলেন, ‘মাদ্রাসার ভবনের ভূমি অধিগ্রহণের নোটিস পেয়েছি। ওই জায়গায় একটি পাকা ঘর আছে, সেটিই মাদ্রাসা। ছাত্রছাত্রীরা এখন পড়তে আসে না বলে আমরা ওই পাকা ঘরটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছি।’
নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি বলেন, ‘ক্লাবঘর ও গুদামঘর ভবনের ৮ ধারার নোটিস মাদ্রাসার নামে হয়েছে। কীভাবে এটা হয়েছে তা মাদ্রাসার সভাপতি ভালো বলতে পারবেন।’
শরীয়তপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিবুর রহমান পিইঞ্জ বলেন, জমির মালিকানা বা মূল্য নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণ শাখা। প্রত্যেকটি স্থাপনার সরেজমিন তদন্ত করা সম্ভব হয় না। কিন্তু নব্বই থেকে পঁচানব্বই ভাগ স্থাপনার সরেজিমন তদন্ত করা হয়।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, নশাসন ইবতেদায়ি স্বাতন্ত্র্য মাদ্রাসার যদি কোনো অস্তিত্ব না থাকে, তবে বিল পাবে না। রেকর্ড গ্রহণযোগ্য দলিল। মাদ্রাসার জমি নিয়ে আদালতে বিরোধপূর্ণ মামলা থাকলে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর প্রকৃত মালিককে স্থাপনা ও জমির ন্যায্যমূল্য প্রদান করা হবে।