× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হোগলাপাতায় স্বপ্ন বোনেন মাফুজুল

আব্দুল্লাহ আল নোমান, আশুলিয়া (ঢাকা)

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:৩৮ এএম

হোগলাপাতার দড়িতে কারুপণ্য তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। বৃহস্পতিবার সাভারের ভাটপাড়া এলাকায়। প্রবা ফটো

হোগলাপাতার দড়িতে কারুপণ্য তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। বৃহস্পতিবার সাভারের ভাটপাড়া এলাকায়। প্রবা ফটো

মাফুজুল গণি, বয়স ৩০। এরই মধ্যে নিজেকে গড়ে তুলেছেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থান, কেড়েছেন বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টি। দেশীয় কাঁচামাল, শ্রম আর মেধার সমন্বয়ে হোগলাপাতা পণ্যে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান।

তরুণ উদ্যোক্তা মাফুজুল গণির জন্ম ও বেড়ে ওঠা দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায়। বাবা ওসমান গণি ছিলেন স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মা মঞ্জুরা তৈয়বা গৃহিণী। এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর ভর্তি হন রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। টেক্সটাইল বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন ২০১১ সালে। সাভারের একটি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নি শেষে সেখানেই চাকরিতে যোগ দেন তিনি। এর পরের গল্পটা স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন ভাঙার ও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার।

নোনাজলের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ হোগলা। এটি মাটির ওপরে ৭৬-৯০ ইঞ্চি লম্বা হয়। প্রস্থ ১ ইঞ্চি। শেকড় মাটিতে থাকে ১০-১২ ইঞ্চি। গোড়ার দিকের শেকড় খানিকটা কচুগাছের মতো। নদীর দুই ধারে জন্মায় গাছ। প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ হোগলাপাতা পেয়ে থাকে। জুলাই-আগস্টে এ পাতা সংগ্রহ করা হয়।

সম্প্রতি সাভারের ভাটপাড়া এলাকায় গড়ে তোলা গণি ক্রিয়েশন কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, টিনের শেড দেওয়া লম্বা ঘরেই চলছে হোগলাপাতার দড়িতে কারুপণ্য তৈরির কর্মযজ্ঞ। দুই পাশে থরে থরে সাজানো বিক্রির জন্য প্রস্তুত কারুপণ্য। দারুণ মিশুক আর তারুণ্যদীপ্ত মাফুজুল গণি গল্পের ঝুড়ি খুলে বললেন, আজকের এ অবস্থানে আসা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল।

চাকরিতে থাকার সময়ে তার কাছে অনেকে আসতেন চাকরির আবদার নিয়ে। কিছু মানুষকে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তবে সবাইকে না। কারণ অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাইলেই নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখান থেকেই মাথায় আসে মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি।

এরই মধ্যে আইইএলটিএস কোর্সসম্পন্ন করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার আবেদন করেন। ভিসা হয় না, কারণ তার পর্যাপ্ত ব্যাংকিং লেনদেন ছিল না। প্রথমবার স্বপ্নভঙ্গ হলেও হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি। এবার ২০১৪ সালে চাকরি ছেড়ে সাভারের যুব উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন। কৃষির ওপর চার মাসের প্রশিক্ষণে হয়েছেন দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে প্রশিক্ষণ শেষে বন্ধুদের আর্থিক সহযোগিতায় সাভারের পাথালিয়া ইউনিয়নের ঘুঘুদিয়া এলাকায় শুরু করেন মুরগির ফার্ম। তিন মাসের মাথায় বন্ধ করে দিতে হয় সিন্ডিকেট সংক্রান্ত জটিলতার কারণে। একই জায়গায় শুরু করেন মাশরুম চাষ। বেশ ভালো উৎপাদন হলেও বিক্রি করার বাজার না থাকায় আবারও হোঁচট খেলেন। তবু দমে যাননি, নতুন করে স্বপ্ন দেখেন নতুন কিছু করার।

যোগ দেন একটি কুটির শিল্প কারখানায়। তবে এবার চাকরি করার উদ্দেশ্যে নয়, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। ২০১৮ সালে তিন মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন সাভারের ভাটপাড়া এলাকায় এবং মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে শুরু করেন হোগলাপাতার কারুপণ্য তৈরির কাজ।

মাফুজুল গণি জানান, বর্তমানে কাজ করেন দুই হাজারের বেশি নারী-পুরুষ। হোগলাপাতা থেকে তৈরি দড়ি আসে দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে। মাত্র একটি রুমে শুরু হওয়া কারখানাটির ব্যাপ্তি এখন চারটি শেডে। এখানকার কারুশিল্পীদের হাতের কারুকার্যে তৈরি হচ্ছে বাসকেট, হ্যাংগিং, ঝুড়ি, টপ, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, নার্সারি পট, মাদুল, সোফা সেট, ফুলদানিসহ প্রায় ২০০ ধরনেরের পণ্যসামগ্রী।

গল্পের একপর্যায়ে মাফুজুল গণির গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে ওঠে। সফলতার আগে নিদারুণ কষ্টের কথা মনে পড়ে যায় বারবার। সেসময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘এ কাজ শুরু করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অর্থাভাবে দিন কেটেছে। শুরুর দিকে মিরপুরের ঝুটপট্টি থেকে সুতা সংগ্রহ করতাম। খরচ কমানোর জন্য মাথায় করে সুতা বয়ে আনতাম। সংকোচে থাকতাম বন্ধু বা পরিচিতজনরা দেখে ফেলে কি না! এক আত্মীয় কারখানার জায়গা ভাড়া দেবেন বলে কথা দিয়েও পরে আর দেননি। স্থানীয় এক বৃদ্ধা এগিয়ে আসেন তখন। এমন বহু বিষয় পাড়ি দিয়ে আজ আমি এখানে।’

একটা সময় পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বায়িং হাউস আর হস্তশিল্পের রপ্তানিকারকদের পণ্য তৈরির কাজই করতেন। সম্প্রতি নিজেই রপ্তানিকারকের খাতায় নাম তুলেছেন। ফ্রান্সে গেছে পাঁচটি আইটেমের একটি চালান, পণ্য গেছে জার্মানিতেও। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ারদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে পেয়েছেন বিশ্বব্যাংকের এক্সপোর্ট রেডিনেস ফান্ডের (ইআরএফ) অনুমোদন, যা তাকে আরও দায়িত্বশীল ও উদ্যমী করে তুলেছে। ২০২২ সালে পেয়েছেন জাতীয় এসএমই ফাউন্ডেশনের বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার।

গণি ক্রিয়েশনের পুরো কারখানা চলছে নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তথা সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এসএমই ফাউন্ডেশনের পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে গড়েছেন গণি ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি)-এ শারীরিক অক্ষমদের জন্য দেওয়া হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের (সিজেডএম) সঙ্গেও দেশের বিভিন্ন জেলায় দুস্থ নারীদের হস্তজাত পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে গণি ক্রিয়েশন।

সাফল্যের পথ ধরে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, কিন্তু সময় স্বল্পতা ও ভিসা জটিলতার কারণে অংশ নিতে পারেননি। এ নিয়ে সাময়িকভাবে কষ্ট পেলেও মোটেই হতাশ নন। বরং আগামী মেলায় অংশ নিতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তার প্রতিষ্ঠিত কারুপণ্যের প্রতিষ্ঠান গণি ক্রিয়েশনে বেতনভুক্ত কর্মী প্রায় ২০০ জন। এ প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ কর্মীই নারী। কর্মীদের জন্য আছে নানা সুযোগ-সুবিধা। গণি ক্রিয়েশনের কর্মীদের রয়েছে স্বাস্থ্যবীমা। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকার কারণে এখানকার কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রয়েছে চিকিৎসা সুবিধা। পাশাপাশি এখানকার নিরক্ষর কর্মীদের জন্য আগামীতে দৈনিক এক ঘণ্টার স্কুল খোলার চেষ্টাও চালাচ্ছেন। নতুন যারা আসেন কাজ শিখতে, তাদের জন্য রয়েছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

গণি ক্রিয়েশনে কাজ করেন রানা প্লাজায় আহত কয়েকজন নারীশ্রমিক। কথা হয় এমনই একজনের সঙ্গে নাম সুরাইয়া, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আটকা পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ঠিকই, তবে আগের মতো আর গায়ে জোর পান না। এ অবস্থায় সবাই কাজে নিতে চায় না। পরে গণি ক্রিয়েশনের খবর পেয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখানে কাজ শুরু করেন। সুরাইয়া বলেন, এখানে কাজ করতে পেরে আনন্দিত। এখানকার কাজের পরিবেশ সুন্দর। সবাই অনেক ভালো ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে। 

পরিবেশবান্ধব পণ্য বানিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি শ্রমবান্ধব কর্মপরিবেশও তৈরি করতে চান এ উদ্যোক্তা। ভবিষ্যতে নিজেদের জায়গায় কারখানা স্থাপন করে আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা