সাতক্ষীরা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:২১ পিএম
সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য অপরিহার্য নানা পণ্য প্রদর্শনী। প্রবা ফটো
জীবন-জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের মুখে প্রাণ দিতে হয়েছে তার স্বামীকে লোকজনের কাছে সোনাবানুর পরিচয় তাই বাঘ-বিধবা। সুন্দরবন এলাকায় দেড় হাজারের মতো বাঘ-বিধবার একজন তিনি। তাকেই দেখা গেল শান্তির পায়রা আকাশে উড়িয়ে দিতে। দেখা গেল ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় উপকূলে জন্ম নেওয়া বন্যাকেও পায়রা ওড়াতে। এভাবেই তারা দুজন উদ্বোধন করলেন ‘ভাটির টানে, বাদার গানে’র প্রদর্শনী। আর উপস্থিত সবাই মিলে গেয়ে উঠলেন জাতীয় সংগীত।
বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকালে সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে হয়ে গেল এ প্রদর্শনী। যা কেবল প্রদর্শনী নয় বরং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও আনন্দ-বেদনার সংগ্রামমুখর কাহিনী।
জমজমাট সারা দিন
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে দেখা গেল উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য অপরিহার্য নানা পণ্য। প্রদর্শনীতে ছিল সুন্দরবনের গোলফল, গোলপাতা, মধু, মোম, বাঁশি, জাল, খারা, স্থানীয় ১৫০ প্রজাতির ধানবীজ, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশ ও বেতের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী, পরিবেশবান্ধব বন্ধু চুলা, কুড়িয়ে পাওয়া পুষ্টিগুণসম্পন্ন সবজি তেলাকুচা, শাপলা, শজিনা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ, কচুফুল, ডুমুর, তিতবেগুন, ব্রাহ্মী, কলার মোচাসহ বৈচিত্র্যময় অথচ অপরিহার্য সব পণ্যসামগ্রী।
অনুষ্ঠানে নৃত্যের তালে, গানের সুরে ও নাটকের অভিনয়ে ফুটে ওঠে স্থানীয় মানুষের জীবনের সংগ্রাম। শিশু-কিশোর যুবক বৃদ্ধসহ সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে জমে ওঠে আয়োজন। দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও সুন্দরবন সুরক্ষায় যুবদের ভূমিকা’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। কৃষিজমি সুরক্ষার দাবি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক সংলাপ। মঞ্চস্থ হয় পথনাটক, পরিবেশিত হয় উপকূলীয় সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নিজস্ব সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও মান-অভিমানের গল্প তুলে ধরে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ।
বক্তাদের কথা ও উপকূল ঘোষণা
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, পরিবেশ ও কৃষিজমি রক্ষায় প্রস্তাবিত আইন ও নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশের সব রকম কৃষিজমি রক্ষা ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বক্তারা তাদের বক্তব্যে নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চলের বাইরে কৃষিজমিতে যেখানে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার ও ইটভাঁটা নির্মাণ বন্ধের দাবি জানান। উন্নয়নমূলক কাজের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের এবং অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, দালান ও বাসভবন নির্মাণ বন্ধের দাবিও করেন তারা।
অনুষ্ঠানে শ্যামনগর উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি, চ্যানেল আই কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক শেখ সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তৃতা করেন অধ্যাপক আব্দুল হামিদ, সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সনাক সাতক্ষীরার সভাপতি হেনরী সরদার, মানবাধিকারকর্মী মাধব দত্ত, নাগরিক নেতা আলী নূর খান বাবুল, অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, কৃষক আশরাফ হোসেন, সাংবাদিক আমিনা বিলকিস ময়না, প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি কর্ণ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক হুমায়ুন কবির, ধুলিহর-ব্রহ্মরাজপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক এসএম শহীদুল ইসলাম, সাংবাদিক রনজিত বর্মণ, বারসিক-এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার, জেলা সমন্বয়কারী মাসুম বিল্লাহ প্রমুখ।
সবশেষে উপকূল ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। এতে উপকূলের মানুষের জানমালের সুরক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, জলবায়ুর সুবিচার, পরিবেশ ও সুন্দরবন সুরক্ষার দাবি জানানো হয়।