মৌলভীবাজার প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:২৫ এএম
আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:২৩ পিএম
শ্রীমঙ্গল থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ফিনলে কোম্পানির ডিনস্টন চা বাগানে শত বছরের স্মৃতি আঁকড়ে আছে ডিনস্টন সিমেট্রি। প্রবা ফটো
দেশে চা উৎপাদনের শুরু থেকেই ব্রিটিশরা এখানে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। সিলেট, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জেও গড়ে ওঠে চা বাগান। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানে গিলবার্ড হেনরি টেট নামে এক ব্রিটিশ ‘টি প্লান্টার’ চা চাষ শুরু করেন। তখন ব্রিটেনের অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে চা চাষাবাদের চাকরি সূত্রে শ্রীমঙ্গলে আসতে থাকেন।
সে সময়ে অনেকেই এই অঞ্চলে মারা গেছেন আবার কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে গেছেন। রাজঘাট চা বাগানে চাকরিসূত্রে এসে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের সমাহিত করা হয়েছে ডিনস্টন সিমেট্রিতে।
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ফিনলে টি কোম্পানির ডিনস্টন চা বাগান। এখানেই শত বছরের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে ডিনস্টন সিমেট্রি। ডিনস্টন চা বাগানে চাকরি করার সময় গিলবার্ড হেনরি টেট ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর মারা যান। তখন তার বয়স ছিল ৩৫ বছর। স্ত্রী-ছেলে নিজ দেশে রেখে এখানে তিনি এসেছিলেন চা উৎপাদক হিসেবে। কয়েক বছর আগে গিলবার্ডের ছেলে পিটার টেট বাবার সমাধি দেখতে প্রথমবারের মতো আসেন বাংলাদেশে। তিনি শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রিতে বাবার সমাধি দেখার পাশাপাশি তার মায়ের অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তার মৃত্যুর পর মরদেহের ভস্ম বাবার সমাধির পদপ্রান্তে রেখে গেছেন।
সুকুমার গোয়ালা নামে স্থানীয় এক চা শ্রমিক জানান, এই সিমেট্রিতে বিদেশিদের কবরের সংখ্যা ৪৬। এর মধ্যে এখানে শায়িত রয়েছেন এক ব্রিটিশ দম্পতি ও ৯ শিশু। পাঁচটি সমাধিতে কোনো নাম পরিচয় উল্লেখ নেই। এই সিমেট্রিতে সমাহিতদের মধ্যে রয়েছেন রবার্ট রয়বেইলি নামে এক ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি ১৮৮৫ সালের ৩০ আগস্ট ৩৮ বছর বয়সে মারা যান। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন জর্জ উইলিয়াম পিটার ও মেরি এলিজাবেথ পিটার দম্পতি।
১৯১৮ সালের ১৮ মে জর্জ উইলিয়াম পিটারের সহধর্মিণী মেরি এলিজাবেথ পিটার মারা যান। অন্যদিকে ১৯১৯ সালের ২ অক্টোবর জর্জ উইলিয়াম পিটার মারা গেলে তাকে এখানে সমাহিত করা হয়। এ ছাড়াও রয়েছেন এডওয়ার্ড ওয়ালেস। ১৯১৯ সালের ২০ জানুয়ারি ব্রিটিশ এই নাগরিক মারা যান। ১৯৩৭ সালের প্রথমদিকে হান্ট নামে একজন ব্রিটিশ নাগরিক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে শ্রীমঙ্গল শহরে মারা যান, তাকেও এখানে সমাহিত করা হয়েছে।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার একটি বিমান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শ্রীমঙ্গলের উদনাছড়া চা বাগানে বিধ্বস্ত হলে ওই বিমানের দুজন চালক মারা যান। এই দুজনের মরদেহও এই ডিনস্টন সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। পরে আমেরিকার সামরিক বাহিনী ওই দুজনের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে নিজ দেশে নিয়ে যায়।
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা এক পর্যটক বলেন, ডিনস্টন সিমেট্রির ইতিহাস মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। অনেক বিদেশি নাগরিক তাদের স্ত্রী-সন্তানকে রেখে চাকরি করতে এখানে এসেছিলেন। মৃত্যুর পর তাদের দেহ এখানেই সমাহিত করা হয়েছে।
নাম পরিচয়হীন একটি সমাধিতে লেখা রয়েছে ‘In Loving Memory of my dearest husband’। এই লেখার নিচেই লেখা রয়েছে জেসিজি। জানা যায়, এই অঞ্চলে কর্মরত এক ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যুর খবর শুনে তার স্ত্রী জেসিজি তাৎক্ষণিক ফ্লাইটে সুদূর ব্রিটেন থেকে শ্রীমঙ্গলে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে তার স্বামীর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়ে গেছে। তাই কফিনে খোদাই করে নিজ হাতে তিনি লিখে গেছেন এই বাক্যটি। পর্যটক ও স্থানীয়দের হৃদয় নাড়া দিতে এই লেখাটি যথেষ্ট!
সূত্র জানায়, ডিনস্টন সিমেট্রির চারপাশে সীমানা দেয়াল ও লোহার গেট। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গেটের ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাইরে থেকে এটি দেখতে হয়। ১৩৮ বছরের স্মৃতিময় এই সিমেট্রি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মরত আছেন চারজন কর্মচারী। প্রতি বছর সিমেট্রিটি রঙ করা হয়। এ ছাড়া এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় সবসময়ই। এখনও অনেক বিদেশি নাগরিক এখানে এসে মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যান। এটি শ্রীমঙ্গলের অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্রও। প্রায় প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক এই সিমেট্রিটি দেখতে ভিড় করেন।