সেলিম রানা, কালিয়াকৈর (গাজীপুর)
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:৪৭ এএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:২৭ পিএম
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার অনেক পরিবার পোশাক কারখানার ঝুট কাপড় দিয়ে পাপোশ তৈরি করে সাবলম্বী হয়েছে। প্রবা ফটো
পোশাক কারখানার ঝুট কাপড় দিয়ে পাপোশ তৈরি করে সাবলম্বী হয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার অনেক পরিবার। উপজেলার রতনপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পাপোশ কারখানা। স্থানীয় বেকার যুবকদের প্রশিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন উদ্যোক্তারা। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা এ পেশায় যুক্ত হয়ে বদলাচ্ছেন ভাগ্য। এসব কারখানায় তৈরি পাপোশ স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালিয়াকৈরে শিল্প এলাকায় ছোট-বড় সহস্রাধিক পোশাক কারখানা রয়েছে। সেখানকার ঝুট কাপড়গুলো আগে ফেলে দেওয়া হতো কিংবা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পোশাক তৈরির কারখানার লাখ লাখ টন অব্যবহৃত কাপড়ের স্থায়ী সমাধান ছিল না। বর্তমানে সেই অব্যবহৃত টুকরো কাপড় দিয়েই তৈরি হচ্ছে ঘরে ব্যবহার করার জন্য বাহারি নকশা ও রঙ-বেরঙের সুন্দর সুন্দর পাপোশ, কার্পেটসহ ঘরের মেঝেতে ব্যবহারের নানা উপকরণ। একসময় উপজেলার রতনপুর এলাকার অনেকে বেকার জীবনযাপন করতেন। পাপোশ তৈরির কারখানা হওয়াতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। পাশাপাশি কারখানার মালিকদের কাছ থেকে কাজ শিখে এখন নিজেরাই ঘরে বসে তৈরি করছেন পাপোশ। একজন দক্ষ কারিগর প্রতিদিন গড়ে চার-পাঁচশ টাকা আয় করেন। বিভিন্ন বয়সের নারীরাও এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পুরুষের পাশাপাশি সংসারের ছোট ছোট চাহিদাগুলোর জোগান দিচ্ছেন।
রতনপুর এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা পাপোশ তৈরির কারখানা ঘুরে দেখা গেছে শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা। নানা রঙের বিভিন্ন কাপড়ের ছোট ছোট টুকরো কাপড় দিয়ে নকশি বুনে বিভিন্ন আকার ও আয়তনের পাপোশ এবং কার্পেট তৈরি করা হচ্ছে। বেশিরভাগ কারিগর পড়ালেখা ও অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য প্রতি পিস মজুরিতে কাজ করছেন। অনেক নারী গৃহস্থালি কাজকর্মের পাশাপাশি ঘরে বসে পাপোশ তৈরি করছেন। পোশাক তৈরির কারখানা থেকে প্রতি টন অব্যবহৃত টুকরো কাপড় গড়ে কিনতে হয় ২৭ হাজার টাকায়। আকার আয়তন ও নকশি ভেদে কারিগরদের প্রতি পিস পাপোশের জন্য ৮ থেকে ৩৫ টাকা দিতে হয়। আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ দিয়ে প্রতি টন কাপড়ের বিপরীতে ১৫০০টি পাপোশ তৈরি করা হচ্ছে। এক টন ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি পাপোশ বিক্রি করে মুনাফা থাকছে ৮-১০ হাজার টাকা।
পাপোশ তৈরির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, পোশাক তৈরির পর টুকরো কাপড়গুলো স্তূপ হয়ে যেত। অনেক সময় নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হতো এই টুকরো কাপড়। আমি একসময় দরিদ্রতার কারণে ভারতে চলে যাই। সেখানে এই কাপড় দিয়ে পাপোশ তৈরির কারখানায় পেটে-ভাতে কাজ করি। কাজ শিখে দেশে ফিরে নিজেই পাপোশ তৈরির কারখানা দিই। প্রথম অবস্থায় আমার পাঁচটি তাঁত দিয়ে কারখানা চালু করি। দক্ষ কারিগর ছিল না। আশপাশের বেকার যুবকদের ডেকে এনে কাজ দিতে শুরু করি। তারা নোংরা ময়লা টুকরো কাপড় দেখে কাজ করতে চাইত না। তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজ শুরু করি। এরপর থেকে তারা যখন প্রতিদিনের আয় প্রতিদিন বুঝে পেতে শুরু করল, তখন থেকে তারা উৎসাহী হয়ে উঠল। বর্তমানে আমার কারখানায় ১৮টি তাঁত রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন শতাধিক পাপোশ তৈরি করতে পারি। আমার এই কারখানায় বর্তমানে কারিগর, সহকারী ও অন্যান্য মিলিয়ে ৫০ জন কর্মচারী রয়েছেন। প্রত্যেকে গড়ে নকশা ভেদে চার-পাঁচশ টাকা আয় করেন। তবে সরকারিভাবে স্বল্প সুদে ঋণের ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে এই শিল্পকে আরও প্রসারিত করা সম্ভব মনে করছেন তিনি।
মোহাম্মদ আলী বলেন, কারখানা তৈরির ফলে স্থানীয় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বাসাবাড়িতে নারীদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পাপোশ কারখানার কারিগর মালিক মিয়া বলেন, ‘আমি কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি এই কারখানাতে কাজ শিখি। বর্তমানে এখানে কাজ করে পড়াশোনার খরচসহ পরিবারের ছোট ছোট চাহিদাগুলো মেটাতে পারছি। এতে করে আমার বাবার কিছুটা খরচ কমে আসছে। আমার হাত খরচের জন্য বাবার কাছে টাকা চাইতে হয় না। নিজে কিছু উপার্জন করতে পারি, মাঝে মাঝে আমার আনন্দ হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য এই কাজের মজুরি বাড়ানোর প্রয়োজন।’
কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এই ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের প্রসারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা করা হবে।