× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

খেয়ার মাঝি মঞ্জিলার লড়াকু জীবন

শরীফুজ্জামান ফাহিম, সাভার (ঢাকা)

প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৩ ১১:২৭ এএম

আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০২৩ ১৮:২৫ পিএম

নদী পারাপারের সামা্য আয়ে সংসার পরিচালনা করেন মঞ্জিলা বেগম। প্রবা ফটো

নদী পারাপারের সামা্য আয়ে সংসার পরিচালনা করেন মঞ্জিলা বেগম। প্রবা ফটো

ঘরে অসুস্থ স্বামী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে। তাদের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিতে এক যুগ ধরে চলছে চল্লিশোর্ধ্ব মঞ্জিলা বেগমের জীবনসংগ্রাম। নিরক্ষর মঞ্জিলার জীবনযুদ্ধের একমাত্র হাতিয়ার ছোট্ট খেয়া নৌকা। বেঁচে থাকার সম্বল হিসেবে বৈঠা হাতে নদীর বুকে ভাসছেন এই খেয়া নিয়ে। নদী পারাপারের সামান্য আয়ে টানাপড়েনে চলে যায় মঞ্জিলার সংসার।

সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের গাজীখালি নদীর বুকে বৈঠা হাতে দেখা মিলবে অসহায় মঞ্জিলা বেগমের। ঠিকানা বলতে খেয়াঘাট থেকে এক কিলোমিটার দূরে গাজীবাড়ি এলাকার ছোট্ট ভাঙা টিনের ঘর। সেখানে দুই মেয়ে রুবি (১৪), রুমানা (৯) ও স্বামী শফিক খানকে নিয়ে বসবাস তার। প্রতিবন্ধী বড় মেয়ে রুবি জন্মের পর থেকে উচ্চতায় বেড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া স্বামী শফিক খান দীর্ঘদিন ভুগছেন শ্বাসকষ্টে।

জানা যায়, গত ২০ বছর আগে শফিক খানের সঙ্গে মঞ্জিলার বিয়ে হয়। কৃষিকাজ ও বর্ষায় খেয়া পারাপার করে চলত তাদের সংসার। তবে এক যুগ আগে স্বামীর শারীরিক সমস্যার কারণে সংসারে হাল ধরতে হয় মঞ্জিলাকে। স্বামী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী বড় মেয়ের চিকিৎসার জন্য অবশিষ্ট জমি বিক্রির পর অনেকটাই নিরুপায় হয়ে পড়েন তিনি। স্বামীর ভাঙা নৌকা মেরামত করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদী পারাপার শুরু করেন তিনি। তবে স্থানীয়দের পারপার করেন বছর শেষে কয়েক মণ চালের বিনিময়ে। অন্য এলাকার মানুষকে পারাপারে যে নগদ টাকা আয় করেন তাই দিয়ে চলে স্বামী ও মেয়ের চিকিৎসার খরচ এবং চারজনের সংসার। ছোট মেয়েকে ভর্তি করেছেন স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

মঞ্জিলার কঠোর সংগ্রামের বিষয়ে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। খেয়ার যাত্রী রফিকুল হাওলাদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মঞ্জিলা তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তার আয়ে পুরো পরিবার চলছে। বড় কোনো ছেলেও নেই যে পরবর্তী সময়ে সংসারের হাল ধরবে। আমাদের গ্রামের পক্ষ থেকে তাকে কিছুটা সহযোগিতা করা হলেও তা যথেষ্ট নয়। সমাজের বিত্তবান, সামর্থ্যবানরা যদি তাকে সহযোগিতা করেন, তাহলে তারা পরিবার নিয়ে একটু সচ্ছলভাবে চলতে পারবে।

স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী শাহান খান বলে, আমরা খেয়াঘাটে এলে তাকে পাই। তিনি আমাদের সাবধানে নদী পার করে দেন। আমাদের পড়ালেখার প্রতি উৎসাহ দেন।

শাহান আরও বলে, ‘তাকে দেখে খুব কষ্ট হয়। এত রোদ ও বৃষ্টিতে তিনি নৌকা চালান। আবার মাঝে মাঝে অসুস্থ হলেও পারাপার না করে পারেন না। আমরাও চাই তিনি অন্য কোনো পেশায় যাক।’

তথ্য নিতে মঞ্জিলার বাড়ি গেলে এগিয়ে আসে ছোট মেয়ে রুমানা। সে আক্ষেপ করে জানায়, একটু বৃষ্টি হলেই বিছানাপত্র গুটিয়ে সারারাত বসে থাকতে হয়। ঘর বৃষ্টির পানিতে ভিজে যায়। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে প্রায়ই কুকুর বিড়াল ঘরে ঢোকে। একটু বাতাস হলেই ঘরের চাল দুলতে থাকে। আমরা সারাক্ষণ ঘরের নিচে চাপা পড়ার ভয়ে থাকি।

মঞ্জিলা বেগমের অসুস্থ স্বামী শফিক খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রায় ১৩ বছর ধরে আমি অক্ষম। আমার জায়গাজমিও নাই যে বিক্রি করে সংসার চালাব। আমার প্রতিদিন ওষুধ লাগে, মাঝেমধ্যে থাকে আবার থাকে না। অনেকটা বাধ্য হয়ে মঞ্জিলা নৌকা চালান। কেউ যদি সাহায্য-সহযোগিতা করে তাহলে তার এই কাজ করতে হয় না। 

খেয়াঘাটে দেখা হয় মঞ্জিলা বেগমের সঙ্গে, যাত্রী পারপারের মাঝে কথা বলেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছোটবেলায় পরিবারের অসচ্ছলতা ও সৎ মায়ের কারণে বাধ্য হয়ে পাবনা থেকে সাভারে আশুলিয়ায় আসেন কাজের সন্ধানে। কখনও মানুষের বাড়িতে কখনও রঙের কারখানায় কাজ করেছেন তিনি। বাসার বাড়িওয়ালা শফিক খানের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেন। তখন স্বামী কৃষি ও খেয়া পারপার করে সংসার চালাতেন। কিন্তু গত ১৩ বছর আগে শ্বাসকষ্ট ও যক্ষ্মা ধরা পড়ে তার। এর মধ্যে দুই মেয়ের জন্ম। একজন স্বাভাবিক হলেও অন্যজন শারীরিক প্রতিবন্ধী।

তিনি আরও বলেন, সংসারের অসচ্ছলতা ও স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগাড়ে কাজের সন্ধান করলেও প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেননি। পরে স্বামীর ভাঙা নৌকা সংস্কার করে বৈঠা নিয়ে নদী পারাপার শুরু করি। প্রথমে গ্রামের মানুষ বিভিন্ন কথা বললেও পরবর্তী সময়ে এলাকাবাসীই উৎসাহ দিয়েছে। 

আয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত খেয়া পারাপার করি। বছর শেষে স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া যায় কয়েক মণ ধান আর চাল। এ ছাড়া এলাকার বাইরে লোকদের পারাপার করে দিন শেষে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। সেই টাকায় স্বামীর জন্য ওষুধ আর বাজার করতে হয়। 

তিনি আরও বলেন, আমার কোনো ছেলে নেই। আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে, কিছুদিন পর আমিও চালাতে পারবো না। তাই যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হতো তাহলে একটি দোকান দিয়ে চলতে পারতাম। মেয়েকে দুই বছর আগে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত কোনো ভাতা পায়নি। 

শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাইদুর রহমান খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমরা তার অবস্থা জানি। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে স্বল্পমূল্যে সরকারি চাল কেনার জন্য কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। 

সাভার উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা কাজী ইসরাত জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, প্রথমত বিষয়টি প্রশংসনীয় যে নারী হিসেবে থেমে থাকেননি। পুরুষদের পাশাপাশি সংসার পরিচালনায় কাজ করছেন। তবে তার বিষয়টি একটু ভিন্ন, বেদনাদায়ক। অন্যান্য দপ্তরে কথা বলে কী করা যায়, দেখা যাক। 

সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমি জানতাম না, আপনাদের মাধ্যমে জানা হলো। তার যদি সাহায্য-সহযোগিতা লাগে নিয়ম অনুযায়ী করা হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা