কাওছার আহমদ, সিলেট
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১১:৩৩ এএম
প্রতীকী ছবি
চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় নিরাপত্তাবাহিনীর ঘন ঘন অভিযানের পর জঙ্গিরা সমতলে ছড়িয়ে পড়েছে। ভূমিবৈচিত্র্য আর প্রবাসীদের টার্গেট করেই নিরাপদ আস্তানা ও প্রশিক্ষণস্থল হিসেবে তারা সিলেট অঞ্চলকে বেছে নিয়েছে। তারা এ অঞ্চলের বহু যুবককে জঙ্গিবাদে উস্কে দিয়েছে।
নিষিদ্ধ পথ অনুসরণ করে নিখোঁজ হয়েছেন অনেকে। জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছে তাদের কেউ কেউ। নিরাপত্তাবাহিনীর মতে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, সীমান্তের সুযোগ গ্রহণ, প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ, প্রবাসীদের বাড়িভাড়ার সুযোগ, ধর্মপরায়ণসহ নানা কারণে জঙ্গিরা সিলেটকে বেছে নিয়েছে।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সম্প্রতি ২৭ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি সামনে আসে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার ইলিয়াছ শরীফ বলেন, ‘ভূমিবৈচিত্র্যের কারণে জঙ্গিরা এই অঞ্চলে আত্মগোপনের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া প্রবাসীদের বাড়ি সহজে ভাড়া নিয়ে আস্থানা গড়ে তোলা যায়। বাসার মালিকরা ভাড়া দেওয়ার সময় আমাদের জানালে ভেরিফাই করে থাকি। এসএমপির কাউন্টার টেররিজম ও সাইবার ইউনিট রয়েছে। এ দুই ইউনিটের মাধ্যমে এখন জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এ অঞ্চলে ২০০৬ সালে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির তৎকালীন প্রধান শায়খ আবদুর রহমান আত্মগোপন করেছিলেন। আতিয়া মহল ও কুলাউড়ায় জঙ্গিরা আস্থানা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ তারা ফাঁকি দিতে পারেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘উগ্রবাদে জড়ানোর জন্য ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ব্যক্তিরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য এই বয়সের কেউ নিখোঁজ হলে আমাদের পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে অনুসন্ধান চালানো হয়। প্রয়োজনে সিটিটিসি ও এটিইউর সাহায্য নেওয়া হয়।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, গত ১২ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামে টিলার ওপরে এক বিচ্ছিন্ন বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১০ জঙ্গিকে আটক করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। রাতভর বাড়িটি ঘিরে রাখার পর সকালে তাদের আটক করা হয়। তাদের সঙ্গে আরও তিন শিশু ছিল। সেখানে সিটিটিসি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পায়। ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে সংগঠনটির প্রধানের নামেই জঙ্গিরা সংগঠিত হচ্ছিল। দলের প্রধান ইমাম মাহমুদও আটক হন সিটিটিসির হাতে। এর দুই দিন পর ১৪ আগস্ট ওই এলাকা ছেড়ে পালানোর সময় আরও ১৭ জঙ্গিকে আটক করে পুলিশে দেন স্থানীয় লোকজন। তারা সবাই ইমাম মাহমুদের কাফেলার সদস্য। এর পরদিন ১৫ আগস্ট সিটিটিসি ভারত সীমান্তবর্তী কুলাউড়া উপজেলার দুর্গম কালাপাহাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের মজুদ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
সূত্র আরও জানায়, ইমাম মাহমুদের কাফেলার সদস্যরা দুর্গম কালাপাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিত। দলের প্রধান ইমাম মাহমুদ খোঁড়া হওয়ায় তাকে কাঁধে করে বহন করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন। কয়েক মাস আগে জঙ্গি দলের সদস্যরা ওই গ্রামের জনবিচ্ছিন্ন ওই স্থান ভাড়া নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে। এরপর থেকে ওই বাড়ি ও পাহাড়ে জঙ্গি সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিত।
এর আগে গত ৮ মে সিলেট নগরীর বিমানবন্দর থানা এলাকা থেকে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়া’র দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিনসহ চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই চার জঙ্গি এর আগে কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছে।
গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গিরা জানিয়েছিল, তারা দলের প্রধানের নির্দেশে সিলেটে অবস্থান করছে। সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় তারা প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করছিল। তারা প্রবাসীদের প্রভাবিত করে মোটা অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করছিল। ‘আনসার আল ইসলামের’ সঙ্গে তারা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়ার যোগাযোগ ও সমন্বয়েরও চেষ্টা চালাচ্ছিল। পলাতক জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ার সঙ্গেও গ্রেপ্তার হওয়া আবদুল্লাহ মায়মুনের যোগাযোগ ছিল।
সিলেট জেলা বারের আইনজীবী মামুন রশিদ বলেন, সিলেট বিভাগজুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। প্রশিক্ষণের জন্য এই দুর্গম পাহাড়ি এলাকাকে বেছে নেয় জঙ্গিরা। এখানকার মানুষ ধর্ম ও অতিথিপরায়ণ। এ ছাড়া প্রবাসীরা ধর্মীয় কাজ ও প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ অনুদান দিয়ে থাকেন। সেই সুযোগ কাজে লাগায় জঙ্গিরা।
এর আগে ২০০৬ সালে সিলেট নগরীর শাপলাবাগের সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির তৎকালীন প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া দক্ষিণ সুরমার আতিয়া মহল, মৌলভীবাজার শহরের নাসিরনগর ও বড়হাট্টায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছিল।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘জঙ্গি নির্মূলে পুলিশ যেভাবে কাজ করছে সেটাকে অনুসরণ করে আমাদের তৎপরতা চলছে। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে কোনো ক্লু নেই, তবে মনিটরিং কার্যক্রম চলছে।’