মাদারগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৩ ১৮:২৮ পিএম
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৩ ১৮:৩০ পিএম
জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভার পালপাড়ায় নিপুণ হাতে মাটির তৈজসপত্র তৈরি করছেন মৃৎশিল্পী। প্রবা ফটো
জ্বালানি সংকট, মাটির দামবৃদ্ধি, বাজারে কাচ, সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতাসহ আধুনিক সরঞ্জামাদি এবং প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে জামালপুরের মাদারগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। আর্থিক সংকটসহ বহুমুখী সমস্যায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন মৃৎশিল্পীরা। পূর্বপুরুষদের এ পেশাকে ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
জানা গেছে, উপজেলার পালপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক মৃৎশিল্পীর বাসস্থান। একসময় মৃৎশিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি মাটির জিনিসপত্র এলাকার চাহিদা মিটিয়ে যেত জেলার বিভিন্ন স্থানে। জিনিসপত্র তৈরি করেই চলত মৃৎশিল্পীদের জীবিকা। দেশের বিভিন্ন জেলায় পূজা-পার্বণে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের কদর ছিল। কিন্তু আজ তেমন নেই, কমেছে পালপাড়ার হাঁকডাক। এখন তাদের পেটের ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়।
একসময় মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, ঘটি, কুলা, কলস, প্রদীপের বিকল্প ছিল না। ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে ছিল মাটির ব্যাংক, শিশুদের খেলার সঙ্গী ছিল মাটির পুতুল। স্বাস্থ্যকর ও সহজলভ্য থাকায় মাটির এসব জিনিস ব্যবহার ছিল প্রায় সব পরিবারেই। বর্তমানে কাচ, সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকসামগ্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকা দুরূহ হয়েছে এ শিল্পের। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুকূল বাজারের অভাবে শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কুমারপাড়ার প্রতিটি ঘরে মৃৎশিল্প তৈরির কর্মব্যস্ততা দেখা গেলেও বর্তমানে সেই কুমারপাড়ায় সুনসান নীরবতা। সময়ের ব্যবধানে বেশিরভাগ পরিবার এ পেশা ছেড়ে যুক্ত হয়েছে ভিন্ন পেশায়।
পৌরসভার পালপাড়া এলাকায় প্রয়োজনের তাগিদে পেশা পরিবর্তনের ভিড়ে এখনও কিছু পরিবার এ পেশা আঁকড়ে ধরে নিপুণ হাতে তৈরি করছে বিভিন্ন তৈজসপত্র। কেউ জিনিসপত্র তৈরির জন্য মাটি প্রস্তুত করছেন, কেউ তৈরি করে বাড়ির সামনে রোদে রেখে দিয়েছেন।
মাদারগঞ্জ পৌরসভার পালপাড়া এলাকার মৃৎশিল্পী অকুল চন্দ্র পাল বলেন, ‘বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে আমরা মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে আসছি। বাপ-দাদার আমলের এ শিল্প আজ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। আঁকড়ে ধরে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আগের মতো তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি না হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।’
মৃৎশিল্পী লিপি রাণী পাল, সূর্যনাথ পাল, বকুল, সুমিত চন্দ্র পাল জানান, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক তৈজসপত্রের কারণে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা কমে গেছে। পাশাপাশি মাটি-লাকড়ির অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধিতে তৈরি পণ্যের সঠিক দাম পাওয়া যায় না। তারপরও বাপ-দাদার এ পেশাকে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। বর্তমানে মাটির তৈরি দই টব-হাঁড়ি, কড়াই ও খেলনা বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চালাতে হচ্ছে।
সাংবাদিক মাহমুদা আক্তার রাইসা জানান, প্লাস্টিক পণ্যের আধুনিক ডিজাইন ও কম মূল্যের কারণে নিপুণ শিল্পকর্মখচিত মাটির জিনিসের কদর কমেছে। ধীরে ধীরে যেন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনোই কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
মাদারগঞ্জ পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুল হাসান জানান, তার ওয়ার্ডে দেড় শতাধিক মৃৎশিল্পী রয়েছেন। যাদের অধিকাংশই নারী। প্রয়োজনের তাগিদে পরিবারের পুরুষেরা কৃষিসহ অন্যান্য কাজের দিকে ঝুঁকেছেন। সরকারিভাবে মৃৎশিল্পীদের ভিজিডি, ভিজিএফ দেওয়া হলেও আলাদা কোনো সহযোগিতা করা হয় না।
মৃৎশিল্পীদের ব্যাংকঋণ প্রদান বিষয়ে স্থানীয় অগ্রণী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, ‘সকল ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ব্যাংক লোন দেওয়া হয়। যদি কোনো মৃৎশিল্পী ব্যাংক লোনের আবেদন করে, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলাম খালেক বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৭১০ জনের অনলাইন জরিপ করে অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ জন মৃৎশিল্পী রয়েছেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকার দুটি কর্মসূচি চালু করেছে। একটি ভাতা কর্মসূচি, অন্যটি সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। আরএসএস কর্মসূচির আওতায় ২০ জন মৃৎশিল্পীকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা হয়েছে।’