লাম্পি স্কিন রোগ
কুড়িগ্রাম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৫০ এএম
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৩ ১০:৩১ এএম
লাম্পি স্কিন রোগে (এলএসডি) আক্রান্ত একটি গরু। প্রবা ফটো
কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে গরুর লাম্পি স্কিন রোগ (এলএসডি)। স্থানীয় জনপ্রিতিনিধিদের তথ্যমতে, গত চার মাসে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯ শতাধিক গরু মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে কয়েক হাজার। বন্যার কারণে ঈদুল আজহায় অনেক খামারি ও কৃষক লোকসানের মুখে পড়েছেন। এখন লাম্পি স্কিন রোগের কারণে খামারিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কারণ জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে এ রোগের টিকা নেই।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গরুর লাম্পি স্কিন ভাইরাসজনিত রোগ। এখন পর্যন্ত এই রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। এই রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরে প্রথমে জ্বর দেখা দেয়। পরে নাক-মুখ দিয়ে লালা বের হয়, পা ফুলে যায়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে চামড়ায় গুটি গুটি ক্ষত হয় এবং পচন ধরে। সেই সঙ্গে চামড়া থেকে লোম উঠে যায়। অনেক গরু মারাও যায়। বড় গরু তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে থাকলেও বাছুরের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
এই রোগ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের উদ্ভাবিত ‘গোট পক্স’ নামের একটি টিকা ব্যবহার করে আসছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। পাশাপাশি বিদেশ থেকেও টিকা আমদানি করা হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে চাহিদার তুলনায় খুবই কম।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে জেলায় প্রথম লাম্পি স্কিন রোগে গরু আক্রান্ত হয়। তবে এ বিষয়ে তাদের কাছে হালনাগাদ সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তথ্যমতে, গত চার মাসে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯ শতাধিক গরু মারা গেছে। আক্রান্ত আছে কয়েক হাজার। আক্রান্ত গরুর স্যাম্পল পাঠিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে প্রাণিসম্পদ কার্যালয় বলে অভিযোগ খামারিদের।
সদর উপজেলার পলাশবাড়ী গ্রামের খামারি আব্দুস সালাম বলেন, ‘লাভের আশায় ৪টি গরু কিনেছিলাম। কিন্তু লাম্পি স্কিন রোগে গোয়ালঘরে এখন আর গরু নেই। প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে গিয়েছিলাম, তারা বলেছে স্যালাইন খাওয়ালে ও সেবা-যত্ন করলেই ভালো হবে। তাদের কথামতো কাজ করেও গরুগুলো বাঁচাতে পারলাম না।’
ভূরুঙ্গামারী উপজেলার চর ভূরুঙ্গামারীর রতন সরকার বলেন, ‘আমার খামারে ৯টি গরু ছিল। কিন্তু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪টি মারা গেছে। বাকি ৫টির শরীরে এখনও লাম্পি স্কিন রোগ আছে। আমাকে পথে বসতে হবে।’
চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ কৃষকের গরুর ল্যাম্পি স্কিন রোগ দেখা দিয়েছে। পল্লী চিকিৎসক কিংবা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। পাত্রখাতা গ্রামের রওশন আরা বলেন, ‘ছওয়া-পোয়ার খরচপাতি আর এখনও ভালো করি চলার জন্যে ৭টি গরু লালন-পালন করছিলং। কিন্তু আজগুবি একটা গরুর গায়োত ফোসকা ওঠা শুরু হইল। তারপর গা’র গোস্ত খসি পরা শুরু হইল। ডাক্তার-কবিরাজ-গাছনা অষুধ দিয়াও গরুটেক বাঁচপের পাইলং না। মোর আরও ৩টা গরুর রোগ হইছে। মুই তো চোখোত শর্ষে ফুল দেকপের নাগছং। এই গরুগুলা গেইলে মুই কি করি বাচিম (বাঁচব)।’
রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এনামুল হক বলেন, ‘রাজারহাটে এই রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে এই উপজেলায় তিন শতাধিক গরু ল্যাম্পি স্কিন রোগে মারা গেছে। এত গরু আক্রান্ত কিংবা মারা গেলেও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে কোনো তথ্য নেই। সরকারিভাবে দ্রুত এই রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করা না গেলে বড় লোকসানের মুখে পড়বে গরু খামারিরা।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোনাক্কা আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রতিষেধক না পাওয়ায় আক্রান্ত গরুকে অধিক পরিমাণে স্যালাইন, জ্বর হলে প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ ও খাবার সোডা খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার না করে গরুগুলোকে মশারির ভেতরে রাখতে বলা হচ্ছে। কিছু পল্লী চিকিৎসক মৃত্যুঝুঁকির ভয় দেখিয়ে ভুল চিকিৎসা করেন। মূলত এতেই বেশি গরু মারা যায়।’
আক্রান্ত ও মৃত গরুর তথ্য ও টিকা না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অফিসে চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসা গরুর হিসাব আছে। কিন্তু এর বাইরের গরু নজরদারিতে থাকে না, তাই সেগুলোর কোনো তথ্য নেই। নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা থেকে ২৩টি গরুর নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) পাঠিয়েছি। এলএসডি নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলায় ১৬ হাজার টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন আমাদের কাছে কোনো টিকা নেই। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। টিকা এলে সংকট কেটে যাবে।’