আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৩ ১১:৩৯ এএম
প্রতীকী ছবি
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের ৪৮ বছর বয়সি শচী রানী কর্মকার ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। মাস ছয়েক আগে বাম স্তনে টিউমার নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। শুরুতে টিউমার ধরেই চিকিৎসা চলছিল। পরে মুখ দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলে বায়োপসি পরীক্ষার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। তাতে তার ব্রেস্ট ক্যানসার শনাক্ত হয়।
দ্বিতীয় স্টেজেই শচী রানীর ক্যানসার শনাক্ত হয়। ইতোমধ্যে লাখ দেড়েক টাকা শেষ। স্বামীহারা শচী গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন সংসার ও তার চিকিৎসার ভার কলেজপড়ুয়া ছেলে অনিকের কাঁধে। চট্টগ্রাম মেডিকেলের রেডিওথেরাপি বিভাগে তার চিকিৎসা চলছে। বিনামূল্যে সেবা মিললেও কিনতে হচ্ছে ওষুধ। প্রতি কেমোতে ২৫ হাজার টাকার মতো ওষুধ কিনতে খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনিক কর্মকার।
একই অবস্থা হালিশহরের চটপটি বিক্রেতা সুমনের (৪০)। দ্বিতীয় স্টেজে তার মুখগহ্বরে ক্যানসার ধরা পড়ে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাড়ছে ক্যানসার রোগী। এই বিভাগে গত বছর নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৫১০ জন। এই সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে এ অঞ্চলের ১৯ হাজার ৭৪১ জন ক্যানসার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
চমেক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে মোট ১৯ হাজার ৭৪১ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০২১ সালে এই বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ১৭ হাজার ৪৭৬ রোগী। তার আগের বছর ২০২০ সালে চিকিৎসা নেন ১৪ হাজার ২১৯ জন।
গত বছরে নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৫৮০ জন, যা মোট রোগীর ৫৫ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৪৫ জন (১৮ শতাংশ) মুখগহ্বরের ক্যানসারে আক্রান্ত, ১২ শতাংশ (৪২৯ জন) খাদ্যনালী ক্যানসারে আক্রান্ত, ৮ শতাংশ ফুসফুস ক্যানসারে, কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত ৬ শতাংশ, পাকস্থলী ক্যানসারে আক্রান্ত ৪ শতাংশ। বাকি ৪২ শতাংশ অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে নতুন করে ২ হাজার ৯৩০ জন আক্রান্ত হয়েছেন গত বছর। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৩২ জন ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত, যা মোট আক্রান্তের ২৫ শতাংশ। এরপরই মুখগহ্বরে আক্রান্ত ৪৬৯ জন, যা মোট আক্রান্তের ১৬ শতাংশ। জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ শতাংশ (৪১০ জন) নারী। খাদ্যানালীর ক্যানসারে আক্রান্ত ৪ শতাংশ (২০৫ জন)। ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত ৪ শতাংশ নারী। বাকি ৩৪ শতাংশ নারী অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাজ্জাত মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ক্যানসার রোগী শনাক্ত প্রতিবছর বাড়ছে। এর কারণ সচেতনতা বেড়েছে। আগে একেবারে লাস্ট স্টেজে ক্যানসার শনাক্ত হতো। এখন দ্বিতীয় স্টেজেই বেশিরভাগ শনাক্ত হচ্ছে। তবে উদ্বেগেরও অনেক বিষয় আছে। আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমরা দ্রুত আরও উন্নতি করার ব্যাপারে আন্তরিক।
এই আন্তরিকতার মধ্যেও নানান সমস্যায় এখানকার চিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগের ৪ কোটি মানুষের ক্যানসার চিকিৎসার একমাত্র ভরসা ৪০ শয্যার এই ওয়ার্ড। একটি রেডিওথেরাপি মেশিন দিয়ে চলছে থেরাপির কাজ। একমাত্র ব্রাকিথেরাপি মেশিনটাও অকেজো।
চমেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘ক্যানসার চিকিৎসা মূলত ইকুইপমেন্ট ও ওষুধনির্ভর। আমাদের যন্ত্রপাতিও পর্যাপ্ত নেই। তবে ১৫ তলাবিশিষ্ট একটি ভবনের কাজ চলছে। এর সপ্তমতলাজুড়ে ৩০০ শয্যার ক্যানসার ইউনিট হবে। সাততলার কাজ প্রায় শেষ। আশা করছি, এক বছরের মধ্যে সেটি চালু করা যাবে। ক্যানসার ইনস্টিটিউট চালু হলে চট্টগ্রামের ক্যানসার চিকিৎসার চিত্র বদলে যাবে।’
ডা. সাজ্জাত মুহাম্মদ ইউসুফ জানান, মা ও শিশু হাসপাতালও ১০০ শয্যার ক্যানসার ইউনিট চালু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এভারকেয়ার হাসপাতালে অত্যাধুনিক ক্যানসার চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
কেন চট্টগ্রামে ক্যানসার রোগী বেশি
ডা. সাজ্জাদ বলেন, ক্যানসারের সবচেয়ে বড় কারণ খাবারে ভেজাল, খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ করে ধূমপান, জর্দা ও তামাকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ। এসব কারণে মুখগহ্বর, গলা ও পাকস্থলীর ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। চট্টগ্রামের মানুষের জন্য আরেকটা বড় সমস্যা এখানকার শুঁটকি। শুঁটকিতে ডিডিটি পাউডার ব্যবহার করা হয়। অন্য খাবারেও প্রচুর ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয়। এর সবগুলোই ক্যানসারের জন্য দায়ী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজির অধীনে পরিচালিত ‘ল্যাবরেটরি অব ইউকারেউটিক জিন এক্সপ্রেশন অ্যান্ড ফাংশন’ এবং চিটাগাং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিলড্রেন সার্জারি (ক্রিকস) যৌথভাবে এক সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশই কক্সবাজার জেলার। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সাতকানিয়া উপজেলায় এ হার ১৫ শতাংশ করে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আরেকটি উপজেলা পটিয়ায় ক্যানসার আক্রান্তের হার ১৩ শতাংশ। উত্তর চট্টগ্রামের মধ্যে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় এ হার ১৩ শতাংশ।
দক্ষিণ চট্টগ্রামে এ হার বেশি হওয়ার পেছনে শুঁটকিতে ডিডিটি কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত তামাক সেবন ও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে অন্যতম। তবে কোনো কোনো চিকিৎসক বলছেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের অতিরিক্ত ঝাল, লাল মাংস খাওয়ার প্রবণতা এবং উপকূলীয় এলাকার অধিবাসীদের সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি খাওয়ার ঝোঁক থেকে ক্যানসার বেশি হচ্ছে।