সাফল্য
সাভার (ঢাকা) প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৩ ১১:০৯ এএম
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৩ ১৫:১৭ পিএম
নারী উদ্যোক্তা মরিয়ম আক্তার লতার মাশরুম চাষ। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা মরিয়ম আক্তার লতা। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন তার মা সেলিনা আক্তার রিনা। মায়ের অনুপ্রেরণা থেকে স্বপ্ন দেখেন নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার। পরিবারের দ্বিমত থাকলেও নিজ ইচ্ছাতে অংশ নেন মাশরুম চাষ কর্মশালায়। সিদ্ধান্ত নেন মাশরুম চাষের। বর্তমানে মরিয়ম আক্তার লতার মাসিক আয় ২ লাখ টাকা। হয়েছেন মাশরুমের প্রথম নারী উদ্যোক্তা। সফল এই উদ্যোক্তা এখন অনেক নারীরই অনুপ্রেরণা।
এমন হাজারো নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে সাভার মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। সাভারের সোবাহানবাগের জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পুষ্টিকর ও সুস্বাদু এ সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন দেশের কয়েক হাজার নারী। সংসারের কাজের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ করে হয়েছেন নারী উদ্যোক্তা। এর মধ্যে কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন মাশরুমের কসমেটিক তৈরির কারখানা, বেকারি, হোটেলসহ মাশরুম সেন্টার। যারা একসময় ছিলেন শুধু গৃহিণী তারাই এখন বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ করে মাসে আয় করছেন লাখ টাকার ওপরে। এই মাশরুম চাষেই মাগুরার ‘ড্রিম মাশরুম সেন্টার’, নীলফামারীর সৈয়দপুরের ‘ফাতেমা মাশরুম’সহ অনেক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া ঢাকার পাপিয়া আক্তার, মরিয়মরা তৈরি করেছেন নতুন নতুন কর্মসংস্থান।
জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে জানা যায়, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং মানুষের পুষ্টির ঘাটতি দূর করতে আশির দশকে জাপানের সহায়তায় দেশে মাশরুম চাষ শুরু হয়। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হলেও এরপর থেকে ধীরে ধীরে দেশে বাড়তে থাকে মাশরুম চাষ। কার্যক্রম গতিশীল করতে সাভারে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেখানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে নারীদের প্রশিক্ষণে চাষের জন্য অর্থ সহযোগিতার পাশাপাশি বিনামূল্যে স্পন প্যাকেট দেওয়া হয়। দিন দিন এতে বেড়েছে নারীদের অংশগ্রহণ।
বর্তমানে জাপান ও চীনে দীর্ঘ সময় ধরেই ওষুধ তৈরিতে মাশরুম ব্যবহার হয়ে আসছে। পরে ইউরোপ ও আমেরিকাতেও মাশরুম চাষ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও এর চাষ হচ্ছে।
একটি গবেষণার হিসাবমতে, প্রায় ১০০ গ্রাম মাশরুমে প্রোটিন ২৫-৩৫ গ্রাম, ভিটামিন ৫৭-৬০ গ্রাম, ৫-৬ গ্রাম মিনারেল ও শর্করা, উপকারী চর্বি ৪-৬ গ্রাম। এতে আঁশের পরিমাণ শতকরা ১০-২৮ ভাগ, যা অন্য খাবারের তুলনায় বেশি।
দেশের প্রথম নারী মাশরুম উদ্যোক্তা ও ঝম ঝম মাশরুম সেন্টারের স্বত্বাধিকারী মরিয়ম আক্তার লতা বলেন, ‘২০০৩ সালে প্রথম তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করি। পরের বছর ৬০ দিনের শিল্প প্রশিক্ষণ শেষে বিনামূল্যে পাওয়া ৫০টি স্পন দিয়ে যাত্রা শুরু করি। নিজ বাড়িতে একটি কক্ষে চাষ শুরু করে নিজেই করতাম মার্কেটিং। প্রতিদিনের আয়ের টাকা জমিয়ে ১ হাজার চারা রোপণ করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমার কাছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন, যাদের স্পন আছে প্রায় ২২ হাজারের ওপরে। তাদের কাছ থেকে মাশরুম সংগ্রহ করে মুন্সীগঞ্জে স্থাপিত কসমেটিকস কারখানা ও উত্তরার বেকারিতে পাঠানো হয়। এতে করে নারী উদ্যোক্তারা লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে আমার দুটি কারখানায় ৪০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।’
সাভারের নারী উদ্যোক্তা পাপিয়া আক্তার ১০ বছর ধরে মাশরুম চাষের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তার ১০ হাজার মাশরুম স্পন রয়েছে। মাশরুম চাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে আমরা ট্রেনিং শেষ করে সেখান থেকে ৫০টি বীজ দেওয়া হয়। ঘরের বারান্দায় চাষ করে মাসে প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করতাম। পরে বাড়ির পাশের একটি জায়গা ও ঘর ভাড়া নিয়ে ৫ হাজার স্পন তৈরি করি। এখন আমার প্রায় ১০ হাজার স্পন আছে। এ দিয়ে মাসে মৌসুম অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় আয় হয়।’
তিনি আরও বলেন, প্রথম স্পন থেকে ২৫ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে ফলন আসে। ২ কেজির একটি স্পন প্যাকেট থেকে একবার ফলনে ৩০০-৫০০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যায়। এতে প্রতিদিন গড়ে ২-৩ কেজি পর্যন্ত বিক্রি সম্ভব। প্রতি কেজি মাশরুম বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকা দরে। অবিক্রীত মাশরুম নষ্ট না করে রোদে শুকিয়ে কেজিপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়।
সাভারের একটি রেস্টুরেন্ট মালিক জানান, বর্তমানে স্যুপ, চপ, নুডলস, সালাদসহ মাশরুমমিশ্রিত খাবারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেই সঙ্গে মাশরুমের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ালে সাধারণ মানুষের মাঝে আগ্রহ বাড়বে।
জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (সাভার) প্রকল্প পরিচালক (উপপরিচালক) ড. মোছাম্মৎ আখতার জাহান কাঁকন বলেন, ‘মাশরুমে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো অ্যাসিড, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধি গুণের কারণে ইতোমধ্যেই এটি সারা বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাশরুম চাষ হচ্ছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বেকারত্ব কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি মাশরুম চাষ করে বাড়তি আয় করতে পারছেন। তাই নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে।’
জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (সাভার) উপপরিচালক ড. মো. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের লক্ষাধিক প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। অধিকাংশ হচ্ছে নারী। আমরা চেষ্টা করছি নারীদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে। পারিবারিক শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নারীরা সহজে মাশরুম চাষ করতে পারেন। স্বল্প পুঁজি ও শ্রম ব্যয় করে অধিক আয় করা সম্ভব।’