চট্টগ্রাম-৯
এস এম রানা, সুবল বড়ুয়া ও আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪৮ এএম
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩ ২০:১৫ পিএম
চট্টগ্রাম-৯, ‘সৌভাগ্যের আসনে’ আগ্রহী অনেকে। প্রবা ফটো
বন্দরনগরীর কোতোয়ালি, বাকলিয়া ও ডবলমুরিং (আংশিক) থানা এলাকা নিয়ে চট্টগ্রাম-৯ আসন। ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয়টি নির্বাচনে এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন; সেই দলই শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। এই সময়কালে এ আসন থেকে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের মধ্যে চারজন ঠাঁই পেয়েছেন মন্ত্রিসভাতেও। তাই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে আসনটি পরিচিতি পেয়েছে ‘সৌভাগ্যের আসন’ হিসেবে। তাদের ধারণা, এই আসনে দলকে জেতানো গেলেই সরকার গঠন নিশ্চিত! তাই এ আসনে প্রার্থী হতে আগ্রহীর অভাব থাকে না কোনো দলেই। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন প্রভাবশালী তিন নেতা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত বিএনপির কেউ প্রার্থিতা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও দলটির স্থানীয় দুই শীর্ষ নেতা পর্দার আড়ালে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নানা তৎপরতা শুরু করেছেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির আবদুল্লাহ আল নোমান এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেবার বিএনপি সরকার গঠন করলে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান নোমান। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে সেই সংসদ ভেঙে গেলে একই বছর অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এম এ মান্নান বিজয়ী হন এবং মন্ত্রিসভায় জায়গা পান। ২০০১ সালের নির্বাচনে নোমান পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিএনপির মন্ত্রী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল ইসলাম বিএসসি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারে অগ্রদূতদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। ২০১৪ সালের জোটগত ভোটের কৌশল অনুযায়ী জাতীয় পার্টিকে এই আসনটি আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলে নুরুল ইসলাম মনোনয়ন বঞ্চিত হন। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন জিয়াউদ্দীন আহমেদ বাবলু। নুরুল ইসলাম বিএসসিকে পরবর্তীকালে টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রী বানানো হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পান চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা ও সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি এখন শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে জয়ের ধারা বজায় রাখতে চান তিনি। নুরুল ইসলাম বিএসসিও এবার মনোনয়ন চান। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইব। ২০১৪ সালে মহাজোটগত কারণে দলীয় সিদ্ধান্তে আমি নির্বাচন করিনি। এবার নির্বাচন করব ভাবছি। তবে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনের জন্য রাজনীতি করি না। আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। মনোনয়নের বিষয়ে তিনি যেই সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই হবে। আমার প্রত্যাশাÑ আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হবেন।’
আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, প্রত্যেক রাজনীতিবিদের মনে সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন থাকে। আমি চট্টগ্রাম ৯ আসনের ভোটার। চট্টগ্রাম শহরের গোড়াপত্তনের আগ থেকে প্রায় ১৪৩ বছর যাবৎ আমরা বংশ পরম্পরায় আন্দরকিল্লা এলাকায় বাস করছি। চট্টগ্রামেই আমার রাজনীতি ও বেড়ে ওঠা। তাই এই আসন থেকে সংসদ নির্বাচন করার ইচ্ছা আছে। দলীয় মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করব।
বিএনপি নেতারা আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনও মুখ খুলছেন না। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে এলে এবং দল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হলে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর মনোনয়ন চাইবেন। এর মধ্যে শাহাদাত গত নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও নির্বাচনকেন্দ্রিক কৌশলী কার্যক্রম চালাচ্ছেন শাহাদাত-বক্কর। দলীয় কর্মসূচির বাইরে আলাদা করে ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মসূচি পালন করছেন তারা। যদিও নগর বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার কাঁধে রয়েছে মামলার ভারী বোঝা। শাহাদাতের নামে মামলা আছে ৮০টিরও বেশি। আবুল হাশেম বক্করের বিরুদ্ধে মামলা আছে ৪৪টি। এর মধ্যে কয়েকটির বিচারও শুরু হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে এসব মামলার কোনোটিতে তাদের সাজা হয়ে গেলে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যেও পড়তে পারে।
নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় হওয়া ছাড়া নির্বাচনে যাব না। তবে দাবি আদায় হলে অথবা দল নির্বাচনে অংশ নিলে তখন এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইব।’
আবুল হাশেম বক্কর বলেন, ‘এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। তবে দল নির্বাচনে গেলে এই আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইব। মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার সবার আছে। দল যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটিই চূড়ান্ত।’
আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে এ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী জাতীয় পার্টির একাংশের প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ। যদিও আগামী নির্বাচনে জোট-মহাজোট কোন পর্যায়ে হবে কিংবা জাতীয় পার্টি এককভাবে প্রার্থী দেবে কিনাÑ সে বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সোলায়মান শেঠ জানালেন, চট্টগ্রাম ৯ সহ বন্দরনগরীর দুটি আসন থেকে একযোগে নির্বাচন করবেন তিনি। এজন্য দলীয়ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দলের নেতাকর্মীরা সঙ্গে আছেন বলেও দাবি করেছেন তিনি।
এদিকে এ আসনে জামায়াতে ইসলামীরও কিছু কর্মী-সমর্থক রয়েছে। তাই ভোটে রাজনৈতিক জোট না হলে এককভাবে প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা আছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো দলটির। তবে আপাতত মুখ না খুললেও নীরবে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানা গেছে জামায়াতের নেতাকর্মীদের কাছে। তারা জানান, গত নির্বাচনে এই আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন মহানগর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আফসার উদ্দিন চৌধুরী। এবারও তাকেই প্রার্থী হিসেবে ভাবা হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যগত কারণে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন তিনি। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘গত নির্বাচনে দলীয়ভাবে আমার নাম রাখা হয়েছিল। এখন তো স্বাস্থ্য ভালো নেই। তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা আপাতত ভাবছি না।’
গত নির্বাচনে এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সিপিবি নেতা মৃণাল চৌধুরী। এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ নেই। ভোটাররা ভোট দিতে পারেন না। তাই দল এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। যদি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং দল যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ভাবে, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এখন কিছু ভাবছি না।’