ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩ ১০:১০ এএম
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মঙ্গলপুর গ্রামের রাজা হরিনারায়ণ দিঘি। প্রবা ফটো
আজ থেকে বহুদিন আগের কথা। তা হবে ১৫৮০ থেকে ১৬০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো একসময়ের। সে সময়ে বৃহত্তর সিলেটসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে বিশাল বিস্তৃত এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্য শাসন করতেন হরিনারায়ণ রায় নামের এক রাজা। তিনি ছিলেন প্রজাদরদি। ওই রাজ্যের রাজপ্রাসাদ ও রাজমন্দির ছিল বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের মঙ্গলপুর গ্রামে। এ গল্পের কতটা ইতিহাসের সাক্ষ্য, আর কতটা জনশ্রুতি, এ নিয়ে বিতর্ক আছে।
তবে, দিঘিটি নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। তেমনই এক জনশ্রুতি- রাজা হরিনারায়ণ রায় যখন রাজ্য শাসন করছিলেন, সে সময়ে পুরো রাজ্যে দেখা দেয় তীব্র খরা। পানির অভাবে রাজ্যের মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজ্যজুড়ে বন্ধ হয়ে যায় চাষাবাদ। দেখা দেয় তীব্র খাদ্য সংকট। পানীয় জলের সংকটও তীব্র হয়ে ওঠে।প্রজাদরদি রাজা হরিনারায়ণ রায় প্রজাদের পানীয় জলের কষ্ট দূর করতে বিশালাকায় দিঘি খননের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর রাজমন্দিরের সামনে ১২ বিঘা (৩৬০ শতক) ভূমিতে খনন করেন বিশাল দিঘি। কিন্তু বিধিবাম। দিঘি খনন করলেও সেই দিঘিতে পানি ওঠেনি এক ফোঁটাও। উপায়ান্তর না দেখে রাজা দিঘির মাঝখানে খনন করেন একটি কূপ। তারপরও পানির দেখা নেই। জনশ্রুতি রয়েছে, এরই মধ্যে পুত্রসন্তানের জনক হন রাজা হরিনারায়ণ রায়। পুত্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর একদিন রাতে রাজা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখেন, তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী রানী ভানুমতী রায় যদি দিঘির কূপে শুদ্ধাচার দেহে এক কলস পানি ঢালেন, তবেই পানিতে পরিপূর্ণ হবে দিঘি। পরের দিনই রাজার নির্দেশে রানী ভানুমতী রায় ভরা কলস নিয়ে দিঘিতে নামেন এবং সেই জল কূপে ঢালেন। সঙ্গে সঙ্গেই পুরো দিঘি জলে পূর্ণ হয়ে যায়। তবে, রানী আর উঠে আসতে পারেন না। চিরদিনের মতো হারিয়ে যান দিঘির অতল জলে। দিঘিটি পূর্ণ হওয়ায় প্রজাদের মনে একদিকে আনন্দের হিল্লোল, আবার রানী ফিরে না আসায় মর্মাহতও হন তারা। প্রজারা দিঘির পানিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাননি রানীকে। এরপরই ওই রাজ্যের পতন ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। প্রিয় সহধর্মিণী রানী ভানুমতিকে হারিয়ে রাজা হরিনারায়ণ রায় রাজ্য শাসনে অমনোযোগী হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে রাজ্যের সবকিছু হাতছাড়া হয়ে যায় তাঁর। একসময় হরিনারায়ণ রাজ্য ছেড়ে চলে যান অজ্ঞাত স্থানে। এসব জনশ্রুতি বংশ পরম্পরায় এলাকায় চালু রয়েছে।
রাজা নেই, রাজ্য নেই; রাজপ্রাসাদের কোনো স্মৃতিচিহ্নও নেই। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে চার শতাধিক বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রাম মঙ্গলপুরে রাজা হরিনারায়ণের দিঘিটি। ছায়াঘেরা দৃষ্টিনন্দন হরিনারায়ণ দিঘিটি এখনও এলাকার মানুষের পানীয়-জলের চাহিদা পূরণ করে চলেছে। বর্তমানে রাজা হরিনারায়ণ দিঘিটি মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম পর্যটন স্পট। এটির তত্ত্বাবধানে রয়েছে কমলগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। পর্যটকদের সুবিধার্থে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে বেশ কিছু স্থাপনা করা হয়েছে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে এ দিঘিতে আসে হাজার-হাজার পরিযায়ী পাখি। প্রায় প্রতিদিনই আকর্ষণীয় এ দিঘি দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আসেন।
মঙ্গলপুর গ্রামের রাজা হরিনারায়ণ দিঘিটি সম্পর্কে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী হরিনারায়ণ দিঘিটি যেভাবে আছে সেভাবে, অর্থাৎ পুরোনো আদলেই রাখা হয়েছে। অপরূপ সৌন্দর্যময় এ দিঘিটিকে কীভাবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করা যায় তা নিয়ে উপজেলা প্রশাসন চিন্তাভাবনা করছে।’