কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৩ ১০:০১ এএম
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৩ ১০:০৩ এএম
পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় সাগরের প্রবল জোয়ার আর ঢেউয়ে জিও টিউব ও ব্যাগভর্তি বালু বিলীন হয়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে বড় বড় র্গ। প্রবা ফটো
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অপরিকল্পিতভাবে ফেলা জিও ব্যাগ। সাগরের প্রবল জোয়ার আর ঢেউয়ে জিও ব্যাগ থেকে বালু চলে গিয়ে তৈরি হওয়া গর্তে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এমনকি প্রাণ পর্যন্ত হারাচ্ছেন পর্যটকরা।
শুধুমাত্র জিও ব্যাগ ফেলে সাগরের অব্যাহত ভাঙন রোধের এই চেষ্টাকে অর্থের অপচয় বলে দাবি করেন পর্যটকসহ স্থানীয়রা। তাদের দাবি, স্থায়ীভাবে কাজ না করে এভাবে জিও ব্যাগ ফেলে বরং সৈকতের সৌন্দর্যকেও নষ্ট করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে দুর্ঘটনা ও ভোগান্তি বাড়ছেই। এভাবে সৌন্দর্য বিলীন হলে যেকোনো সময় ভ্রমণপিপাসুরা কুয়াকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন বলে আশঙ্কা তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বালু ক্ষয়ের কারণে প্রতিবছরই ভাঙছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। বিলীন হচ্ছে এলাকার বিভিন্ন স্থাপনা। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সৈকত রক্ষার নামে পাউবো কয়েক দফায় ৮ কোটি টাকা ব্যয় করলেও বাস্তবে তেমন কাজে আসেনি। উল্টো খানাখন্দের কারণে পর্যটকরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
পাউবোর কলাপাড়া সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে সৈকতের দুই কিলোমিটার এলাকায় জিও টিউব ও ব্যাগ ফেলে পাউবো। এগুলো কিছুদিন পর সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। ২০২১ সালে ৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং গত বছর ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ফের জিও টিউব ও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। সেগুলো কাজে না এলেও চলতি বছর ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় জিও টিউব ও ৩৭ হাজার জিও ব্যাগ দিয়ে অস্থায়ী বাঁধ করা হচ্ছে।
স্থানীয় ও পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কয়েক বছর ধরে সৈকত রক্ষায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাস দিচ্ছে পাউবো। অথচ আবারও ২ কোটি টাকা ব্যয়ে জিও টিউব ও ব্যাগ বসাচ্ছে। কাজের শিডিউলে অন্য স্থান থেকে বালু এনে জিও টিউব ও ব্যাগ ভরার কথা রয়েছে। কিন্তু সৈকতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলে কাজ করা হচ্ছিল। খবর পেয়ে প্রশাসন তা বন্ধ করে দিলে বাইরে থেকে বালু আনার শর্তে কাজ করছে। এতে শুধু অর্থেরই অপচয় হচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। পাশাপাশি পর্যটকদের ভোগান্তি তো আছেই। এমন পরিস্থিতিতে তাদের দাবি– গ্রোয়েন বাঁধের মাধ্যমে সৈকত রক্ষায় টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া হোক।
পর্যটন ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা চাই সৈকতে বেড়াতে এসে ভ্রমণপিপাসুরা যেন নিরাপদ থাকেন। কিন্তু এভাবে দুর্ঘটনার ভয় থাকলে তারা বরং আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। কেউ নিজের পয়সা খরচ করে ভোগান্তি জন্য বেড়াতে আসে না। সৈকত রক্ষায় জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা করে স্থায়ীভাবে কাজ করতে হবে।
বরিশাল থেকে আসা পর্যটক কাজী সাইফুল জানান, তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন। কিন্তু জিরো পয়েন্ট থেকে নামতে গিয়ে ছেঁড়া-ফাটা বস্তায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। কিছু এলাকায় খানাখন্দ রয়েছে, যাতে সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় হতাশ হয়েছেন।
পর্যটন ব্যবসায়ী কেএম বাচ্চু বলেন, জোয়ারের সময়ে বালু ক্ষয় হয়ে জিও ব্যাগের মাঝে খানাখন্দ তৈরি হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিছুদিন পর এসব বিলীন হয়ে যায়। পরে আবার প্রকল্প নিয়ে একই কাজ করা হয়। এভাবেই চলে আসছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) প্রেসিডেন্ট রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘বর্ষা মৌসুম এলেই পাউবো সৈকত রক্ষার নামে অস্থায়ী প্রকল্প হাতে নেয়; যা কোনো কাজে আসে না। কুয়াকাটায় দরকার স্থায়ী প্রকল্প নেওয়া। এতে সৈকত রক্ষা পাবে, সৌন্দর্যও বাড়বে। এখন যা করছে তা অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু দেখি না।’
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, সৈকত রক্ষায় যে পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে, এগুলো সাময়িক। এক বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার দাবি জানান তিনি।
ট্যুরিস্ট পুলিশের কুয়াকাটা জোনের পরিদর্শক হাচনাইন পারভেজ বলেন, বস্তা ও টিউবে যে খানাখন্দ তৈরি হয়েছে, তাতে হাত-পা ভাঙাসহ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পর্যটকরা। গত বর্ষায় ঢাকা থেকে আসা এক পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে।
কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সৈকত রক্ষায় জিও টিউব ও ব্যাগ ব্যবহার নদী রক্ষার ডিজাইনে করা হচ্ছে। এগুলো করা উচিত সমুদ্র রক্ষার ডিজাইনে। সঠিকভাবে কাজ করার জন্য তদারকি চলছে।
জানতে চাইলে পাউবোর কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন অলীদ বলেন, চার বছরে জিও টিউব ও ব্যাগের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে সৈকত রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে আগের চেয়ে ভাঙন রোধ হচ্ছে।
দুর্ঘটনা ও সৌন্দর্য নষ্টের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্প নামে ৭৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে স্থায়ীভাবে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার কাজ শুরু হবে।