যুক্তরাষ্ট্রে হামলায় নিহত রমিমের মায়ের আহাজারি
আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৩ ২০:০২ পিএম
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৩ ২১:০২ পিএম
ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা মা নাসিমা আক্তার। বুধবার তোলা। প্রবা ফটো
স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তানকে নিয়ে অকূল-পাথারে পড়েন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের গৃহিণী নাসিমা বেগম। তার দিন ফেরাতে ২০১৬ সালে প্রবাসী ছোট বোন তার ছোট ছেলে ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ রমিমকে দত্তক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। তখন রমিমের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। পড়াশোনার পাশাপাশি পাঁচ বছর ধরে মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্টলুইসে একটি পেট্রোল পাম্পে চাকরি করতেন তিনি, অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছিলেন। পরিকল্পনা ছিল আগামী বছর মাকে নিয়ে যাবেন সে দেশে। কিন্তু তা আর হলো না। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) রাত সাড়ে তিনটায় কর্মস্থলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন রমিম।
নিহত রমিমের বড় ভাই রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ রিহাব বলেন, ’সন্ত্রাসীরা রমিমের গাড়ি চুরির সময় টের পাওয়ায় তাদের বাধা দেওয়ার পর তাকে গুলি করে। এতে তার মাথায় গুলি লাগে। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতাল নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় মা নাসিমা। তার নিকটাত্মীয়দের বেশিরভাগ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট এলাকায়। স্বামীর চাকরির সুবাদে উপজেলা সদরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বর্তমানে বড় ছেলে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে নগরীর গণী বেকারি মোড় এলাকার ফেরদৌস টাওয়ারের এক ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি।
দুপুরে সেই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলের শোকে মুহ্যমান হয়ে শয্যাশায়ী নাসিমা। বিলাপ করে বলছিলেন, ‘সারা দিন ভিডিও কলে কথা বলত ছেলেটা। কাজ করত আর মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বলত। মালিক তাকে খুব পছন্দ করত। কয়েক দিন আগে কোম্পানির মালিক ভিডিও কলে রমিমের হাত ধরে আমাকে বলেছিল, ভালো ব্যাটা জন্ম দিয়েছেন। আপনার কোনো চিন্তা নাই। এখন সন্ত্রাসীরা আমার সেই ভালো ব্যাটাকে মেরে ফেলল।’
রিয়াজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ’২০১৩ সালে তাদের বাবা অধ্যাপক সালাউদ্দিন মারা যান। তিনি মিরসরাই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন।’
রিয়াজ বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তখন আমি অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি। রমিমের বয়স তখন ১৩ বছর। আমাদের সহযোগিতা করতে আমার খালা রমিমকে দত্তক হিসেবে নিয়ে যান।’
রিয়াজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের কক্সবাজার রিজিওনাল অফিসে মানবসম্পদ বিভাগে চাকরি করছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। রাজনীতি করা লোকজন নিজের অনুভূতি খুব ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারে না। আমিও কখনও সেভাবে প্রকাশ করতে পারিনি, তাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম। সে আমার সবকিছুতে বড় অংশীদার ছিল। আমার কাছে সে সন্তানের মতো ছিল।’ এসব বলেই অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করেন রিয়াজ। কান্না থামিয়ে পুনরায় বলতে থাকেন, ‘খুব সাহসী ও শৌখিন ছিল। এর মধ্যেই সে ৮টা গাড়ি কিনেছে। সেগুলো উবারে ভাড়া দিয়েছে। বলেছিল, বিজনেস ক্লাসে টিকিট করে দেশে বেড়াতে আসবে। আবার মাকে নিয়ে ফিরবে যুক্তরাষ্ট্রে। কত শখের কথা বলত। সব শেষ হয়ে গেল।’
রমিমের লাশ কোথায় দাফন করা হবে, তা এখনও ঠিক করেননি উল্লেখ করে রিয়াজ বলেন, ‘এখনও রমিমের লাশ হস্তান্তর করেনি যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ। আমার খালা এখনও লাশ দেখেননি। লাশ পাওয়ার পর সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নেব। তার মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সেই লাশ আমরা দেখতে পারব বলে মনে হয় না। এখানে মরদেহ আনতে আরও ছয়-সাত দিনের প্রক্রিয়া। এসব ভেবে মনে হচ্ছে, সেখানে দাফন করা ভালো হবে। আবার দেশে আনা গেলে বাবা-ভাইয়ের পাশাপাশি কবর থাকত। সব মিলিয়ে একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি।’