কুষ্টিয়া প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৩ ১৩:০৯ পিএম
গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত ঐতিহাসিক ‘এম এন প্রেস। প্রবা ফটো
গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত ঐতিহাসিক ‘এম এন প্রেস’টি জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরে চুক্তি হয়েছে। গত শনিবার বেলা ১১টায় ঢাকা শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের নবনির্মিত বোর্ড সভাকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিনামা সই হয়।
রবিবার (১৬ জুলাই) বিষয়টি জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান নিশ্চিত করেছেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় জাদুঘর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক।
জানা গেছে, স্বত্ব হস্তান্তর চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন কাঙ্গাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধরের স্ত্রী গীতা মজুমদার। জাতীয় জাদুঘরের পক্ষে স্বাক্ষর করেন মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান। এ সময় চুক্তিপত্রের সাক্ষী কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের পঞ্চম বংশধর দীপঙ্কর মজুমদার ও কুমারখালীর স্থানীয় সাংবাদিক কে এম আর শাহিন উপস্থিত ছিলেন। প্রেসটি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাস্তুভিটা থেকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘরে স্থানান্তরিত করা হবে।
হস্তান্তর চুক্তি প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতাকারী সাংবাদিক শাহিন বলেন, দুই পক্ষের সমন্বয়হীনতার অভাবে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণে প্রেসটি বাস্তুভিটায় রেখে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব বংশধরদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে রাজি হননি তারা। বিনিময়ের মাধ্যমে স্বত্ব হস্তান্তর করেছেন তারা।
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের পঞ্চম বংশধর দীপঙ্কর মজুমদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ২০ লাখ টাকার চেক ও দুইজনের চাকরির বিনিময়ে তার মা প্রেসটি হস্তান্তরের চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেছেন। চেকটি তারা হাতে পেয়েছেন। এই বিনিময়ে তারা খুব খুশি।
কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ওবাইদুল্লাহ বলেন, ২০১৭ সালে স্মৃতি জাদুঘরটি চালু হলেও প্রেসটি এখনও কাঙ্গাল হরিনাথের বাস্তুভিটায়। দর্শনার্থীরা এসেই আগে প্রেসটি দেখতে চান। নানা জটিলতার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে স্বত্বটি হস্তান্তর করছেন বংশধররা। শিগগিরই জাদুঘরে দেখা যাবে প্রেসটি।
গবেষক গৌতম কুমার রায় জানান, উনিশ শতকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে জন্ম নিয়েছিলেন একজন প্রাতঃস্মরণীয় সাংবাদিক, সমাজসংস্কারক ও প্রজাদরদি ব্যক্তিত্ব। তার নাম কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। সেই ১৮৬৩ সালে স্বশিক্ষিত কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা ও যাবতীয় সাহিত্যকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন।
কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা কলকাতার গিরীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন যন্ত্রে প্রথম মুদ্রিত হয়। পরে ১৮৭৩ সালে কাঙ্গালের নিজ বাড়িতে প্রেস স্থাপনের পর সেখানেই প্রাচীন বাংলার অন্যতম এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটিতে প্রজাদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা তুলে ধরা হতো সাহসিকতার সঙ্গে। সামাজিক সমস্যা-নিপীড়ন, শোষণ কিংবা যেকোনো অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হতো গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায়।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় কলকাতার অদূরে কোনো এক গভীর জঙ্গলে বসে কাঙ্গাল হরিনাথ ইংরেজবিরোধী পুস্তিকা-লিফলেট প্রকাশ করতেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। সংবাদপত্র ও সাহিত্যসেবী কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে না পারলেও শিক্ষা-সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চায় তার ছিল প্রবল আগ্রহ। তার ক্ষুরধার লেখনীর কারণে তৎকালে তার মুদ্রণযন্ত্রটি বাজেয়াপ্ত ও নিলামে বিক্রি করা হলে কুমারখালীর ব্যবসায়ী মুথুরানাথ বাবু তা কিনে নেন।
পরবর্তীকালে তিনি কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের কাছে এই মুদ্রণযন্ত্রটি হস্তান্তর করেন। তারপর থেকেই কাঙ্গাল কুঠিতে স্থাপিত সেই ছাপাখানাটি এম এন প্রেস নামেই পরিচিতি লাভ করে।