× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাবা দিবস আজ

ডাক্তার ছেলেরা আমেরিকায়, বাবা বৃদ্ধাশ্রমে

রেজাউল করিম, গাজীপুর

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৩ ১৩:০৭ পিএম

আপডেট : ১৮ জুন ২০২৩ ১৫:৩৫ পিএম

গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়ায় বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র। প্রবা ফটো

গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়ায় বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র। প্রবা ফটো

মো. রফিকুল ইসলাম, বয়স ৬৭। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। ঢাকার বড় বড় হাসপাতালেও কাজ করেছেন। একজন-দুজন নয়, চার ছেলেসন্তানের বাবা তিনি। দুই ছেলে চিকিৎসক আর দুই ছেলে প্রকৌশলী। তারা সবাই সপরিবারে আমেরিকায় থাকেন।

চার বছর আগে সন্তানরা তাদের মাকেও নিয়ে যান আমেরিকায়। রফিকুল ইসলামের আশ্রয় এখন গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে। নিঃসঙ্গ, একা। বৃদ্ধ এই বাবা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অতীত দিনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান।

শুধু রফিকুল ইসলাম নন, তার মতো অনেক অসহায় বাবার আশ্রয় হোতাপাড়ার মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রসহ অনেক বৃদ্ধাশ্রমে। কেমন আছেন এই অসহায় পিতারা, কীভাবে কাটছে তাদের দিন? স্ত্রী-সন্তান, স্বজন- কেউ কাছে নেই তাদের। 

আজ বিশ্ব বাবা দিবস। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বব্যাপী বাবা দিবস উদযাপন করা হয়। পশ্চিমা বিশ্বে এ ধারণা প্রচলিত হলেও আমাদের দেশেও দিনটি উদযাপন করা হয়। চলুন, বাবা দিবসে শুনি বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত অসহায়দের দিনযাপনের গল্প।

রফিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। থাকতেন রাজধানীর আজিমপুরে। এক সময় অনেক বন্ধু ছিল, ছিল স্বজন। দুই ছেলেকে ঢাকায় লেখাপড়া করিয়েছেন আর দুই ছেলে পড়াশোনা করেছে আমেরিকায়। হঠাৎই ব্রেন স্ট্রোক করে, অসুস্থ হয়ে পড়েন রফিকুল ইসলাম। ছেলেরা তাকে আমেরিকা নিয়ে যাবে, চিকিৎসা করাবে- মনে আশা ছিল। এমনকি ছেলেরা কথাও দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর নেয়নি। এক সময় স্ত্রীও সন্তানদের কাছে আমেরিকা চলে যান। শেষ পর্যন্ত অসুস্থ রফিকুল ইসলামের ঠাঁই হয় হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে। আজ ঠিকভাবে ছেলেদের নামও মনে করতে পারেন না। ছেলেরা এখন আর তার কোনো খোঁজ নেন না। বাবার মন- তার পরও ছেলেদের দেখতে ইচ্ছা করে। তাদের খোঁজ না পেয়ে হতাশায় কাঁদেন। 

কথা হয় রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার যত উপার্জিত সম্পদ, নগদ টাকা- সব নিয়ে গেছে ছেলেরা। তা নিয়ে যাক, কোনো আপসোস নেই। কিন্তু কেউ বৃদ্ধ বাবার খোঁজও রাখে না। এতকিছুর পরও বাবা হিসেবে আমি সব সময় চাই ছেলেরা ভালো থাকুক। আমি চাই ওরা এসে আমাকে নিয়ে যাক। বাবা হিসেবে এখন এটুকুই চাওয়া।’ বৃদ্ধাশ্রমে নামাজ, বই আর পত্রিকা পড়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করেন রফিকুল ইসলাম। সব সময় তার মনে পড়ে স্ত্রী-সন্তানদের কথা।

রফিকুল ইসলামের মতো এমন ১১০ জন অসহায় বাবার ঠাঁই এখন গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মণিপুর বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে। 

গতকাল শনিবার সকালে কথা হয় অসহায় এসব ‘বাবা’র সঙ্গে। এসব বাবার জায়গা হয়নি তাদের সন্তানদের বাড়িতে। বাধ্য হয়েই অনেকে নিজে থেকে আবার কোনো কোনো সন্তান বোঝা মনে করে বাবাকে রেখে গেছে বৃদ্ধাশ্রমে। এখন এই বৃদ্ধাশ্রমই তাদের কাছে হয়ে উঠেছে আপন ঠিকানা। বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিচারণ করে কাটিয়ে দেন সময়। কেউ কেউ অভিমানে মুখ খোলেন না। কথা বলতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। 

আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা ইসরাইল হোসেন। আরেক ভাগ্যতাড়িত পিতা তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পোশাক কারখানায় চাকরি করত ছেলে। ভাড়া বাসায় থাকতেন ছেলের সঙ্গে। এক দিন ছেলে আর ছেলের বউ তাকে ফেলে চলে যায়, কিছু জানতেই পারেননি ইসমাইল হোসেন। কয়েক মাসের বাসাভাড়া বাকি। ছেলে ফিরে না আসায় এক মাস পর বাড়ির মালিক বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। পরে কিছুদিন একটি মসিজিদে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেও চলে আসতে হয়। কোথাও জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়েই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন বৃদ্ধাশ্রমই তার শেষ ঠিকানা। ভালোই আছেন। তবে সব সময়ই ছেলেকে কথা মনে পড়ে।

তিনি বলেন, ‘আমি ওর বাবা ছিলাম। আমাকে একটু জায়গা দিলে ওদের কী এমন ক্ষতি হতো? কত কষ্ট করে নিজে না খেয়ে সন্তানকে মানুষ করেছি। তার পরও ছেলে আমাকে ফেলে পালিয়ে গেল!’

রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী (৭১)। এক সময় জনতা ব্যাংকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে। দুই ছেলে চাকরি করে, এক মেয়ের বিবাহ দিয়েছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলের বাসায় থাকতেন। কিন্তু খুব বেশিদিন সেখানে তার জায়গা হয়নি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলের বাসায় থাকতাম। ছেলে, ছেলের বউ দুজনই চাকরি করত। আমাকে তাদের ঢাকার উত্তরার বাসায় তালা লাগিয়ে চলে যেত। সারা দিন বের হতে পারতাম না। ঘরের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসত। পরে খোঁজখবর নিয়ে নিজে থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছি। ছোট ছেলে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে শুনেছি। কিন্তু খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। সৎভাবে জীবনযাপন করেছি। কখনও অবৈধ টাকা আয় করিনি।’ এখনও মনে তার আকাঙ্ক্ষা- যদি সন্তানরা এসে নিয়ে যেত! কিন্তু তারা দেখতেও আসে না, শুধু মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে জানতে চায় কেমন আছেন- হতাশ কণ্ঠে জানান রিয়াজ চৌধুরী।

গাজীপুর সদরের মণিপুর বিশিয়া এলাকার খতিব আবদুল জাহিদ ১৯৮৭ সালে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায় ১২ কক্ষের একটি বাড়িতে এই বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটিকে মণিপুর বিশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২১ এপ্রিল নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই সময় থেকেই কেন্দ্রটিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে সন্তানের কাছে আশ্রয় না পাওয়া এমন শতাধিক বৃদ্ধ বাবার। বর্তমানে এই কেন্দ্রে বৃদ্ধ পুরুষ রয়েছেন ১১০ জন আর নারী ৯৭ জন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, যারা চরম স্বার্থপর তারাই বাবা-মায়ের প্রতি এমন বিরূপ আচরণ করেন। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা সম্ভব নয়। জীবনের পেছনে দৌড়ানো, টাকার পেছনে ছুটে চলা দিন দিন আমাদের অমানবিক করে তুলেছে। ফলে বৃদ্ধাশ্রমে বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কোনোভাবেই একজন বাবার কাছে তার সন্তানের অভাব পূরণ করা যায় না। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এখানে যারা আছেন, ভালো আছেন। আমাদের সবাইকে নিয়ে তারা ভালো থাকার চেষ্টা করেন। ৬০ বছরের বেশি বয়স হলেই যে কেউ বিনা খরচে এই প্রবীণ নিবাসে থাকতে পারেন।’

জাহাঙ্গীর আলম জানান, এখানে থাকাবস্থায় কেউ মারা গেলে আমরা পরিবারকে খবর দেই। কেউ নিয়ে যেতে চাইলে মরদেহ পাঠিয়ে দেই আর না নিতে চাইলে এখানেই দাফন করা হয়। তবে দুঃখ লাগে, মারা যাওয়ার পর অনেকের পরিবার ফোনই ধরে না। ধরলেও মৃত্যুর সংবাদ শুনে ফোন বন্ধ করে দেয়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা