মৌলভীবাজার প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩ ০৯:২২ এএম
আপডেট : ০৯ জুন ২০২৩ ২২:৫৯ পিএম
মৌলভীবাজার পৌরসভায় অবস্থিত প্রবীণাঙ্গন। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
গাছপালায় ঘেরা শান্ত পরিবেশ। এলাকার প্রবীণরা সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাহাঁটি করেন গাছের ছায়ায়। ক্লান্ত হলে কোথাও বসে বিশ্রাম নেন। কখনও আড্ডায় মেতে ওঠেন নিজেদের মধ্যে। ছায়া-সুনিবিড় প্রাঙ্গণে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের বিশ্রামের জন্য আলাদা ঘরও আছে। সেখানে বিছানার ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রবীণ নারীদের জন্যও আছে আলাদা ব্যবস্থা।
লাইব্রেরি আছে, আছে খেলাধুলার জায়গা। প্রাঙ্গণের মিলনায়তনে ছোটখাটো অনুষ্ঠানও করা যায়। চা-কফি, টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা, সবই আছে। আছে ফুলের বাগান। প্রতিদিন বসে শহরের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মিলনমেলা। যারা সারা জীবন সংসারের ঘানি টেনেছেন- একটু আড্ডা, একটু আনন্দে কাটাবেন জীবনের শেষদিনগুলো। না, এটা কোনো কল্পজগতের গল্প নয়। জেলা শহর মৌলভীবাজারের উপকণ্ঠেই রয়েছে এরকম একটি জায়গা, যার নাম প্রবীণাঙ্গন।
মৌলভীবাজার পৌরসভার বর্তমান মেয়র মো. ফজলুর রহমান নির্বাচিত হওয়ার পর নাগরিকসেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নেন। তার অন্যতম এই ‘প্রবীণাঙ্গন’।
শহরের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জীবনের শেষদিনগুলোকে একটু আনন্দময় করার জন্য ২০১৯ সালে পৌরসভার অর্থায়নে শুরু হয় ‘প্রবীণাঙ্গন’ তৈরির কাজ। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর এটির উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি। উদ্বোধনের পরপরই ‘প্রবীণাঙ্গন’ শহরের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত স্থানটিতে জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা এসে হাঁটাহাঁটি করেন, নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মেতে ওঠেন, বই পড়েন, খেলাধুলা করেন, টেলিভিশন দেখে সময় কাটান।
প্রবীণাঙ্গনের পূর্বপাশে পৌরসভার জনমিলন কেন্দ্রের তিনটি কক্ষকে সংস্কার করে একটিতে পাঠাগার, একটি কক্ষে টেলিভিশন এবং একটিতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঠাগারে স্থান পেয়েছে নানা ধরনের বই। বিশ্রামকক্ষে রয়েছে দুটি শয্যা। জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা হাঁটাচলা ও খেলাধুলা করে ক্লান্ত হলে বিশ্রামকক্ষের শয্যায় বিশ্রাম নিতে পারেন। অপরদিকে বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা একটি কক্ষ। এই কক্ষে নারীরা বিশ্রাম নিতে এবং আড্ডা দিতে পারেন। অঙ্গনজুড়ে রয়েছে ফুলের বাগান। বাগানে বেশকিছু বসার ব্রেঞ্চ। শিগগির পত্রিকা ও চা-কফি কর্নারের ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিদিনই প্রবীণাঙ্গন হয়ে ওঠে শহরের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মিলনমেলা। অনেকে তাদের নাতি-নাততিদেরও নিয়ে আসেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পাকিস্তান আমলে মৌলভীবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্রে তৎকালীন সরকার ‘জিন্না হল’ নামে একটি অডিটোরিয়াম স্থাপন করে। দেশ স্বাধীনের পর এটির নাম বদলে করা হয় ‘জনমিলন কেন্দ্র’। পরে ‘জনমিলন কেন্দ্র’ শব্দটির আগে ‘পৌর’ শব্দ জুড়ে দিয়ে করা হয় ‘পৌর জনমিলন কেন্দ্র’। একসময় মৌলভীবাজার শহরের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভা-সমাবেশ, শিল্প-সংস্কৃতির আয়োজন, নাটক বা নৃত্যানুষ্ঠান- সব ধরনের আয়োজনে এ হলের কোনো বিকল্প ছিল না। পৌরশহরের দক্ষিণ প্রান্তে এবং জেলা জজ আদালতের উত্তর প্রান্তে ছোট একটা টিলার ওপরে এই জনমিলন কেন্দ্র। চারপাশের গাছগাছালি এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। পৌর জনমিলন কেন্দ্রের আগের দালান ও আশপাশের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সম্পূর্ণ বদলে গেছে কেন্দ্রটির পুরোনো চেহারা। জনমিলন কেন্দ্রের সামনে থেকে পেছনের অংশ পর্যন্ত সুবিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘প্রবীণাঙ্গন’।
সাজানো হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যকলায়। ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বমানের উপকরণ। ফুলবাগানে স্থান পেয়েছে ডালিয়া, অ্যারোমেটিক জুঁই, ব্লাডেড হার্ট, ল্যান্টেন জবা, পাউডার পাফ, নিলাঞ্জন, সারভেরা, গোল্ডেন শাওয়ার, রেড পেন্ডা, চায়নিজ ফ্রিং ফ্লাওয়ার, জেসমিন, অ্যারাবিয়ান জেসমিন, বগেনভেলিয়া, বাসর লতা, বিচিত্রা, পিংক ম্যাগনেলিয়া, টিবু চায়না, মে ফ্লাওয়ার, টেকোমা, ক্যামেলিয়া, কয়েক জাতের গোলাপ ও জবা, দৃষ্টিনন্দন বকুল, রঙ্গন, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বকুল, গন্ধরাজ, চেরি, স্থলপদ্ম, হাসনাহেনাসহ প্রায় ৫০ জাতের দুই শতাধিক দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ। প্রবীণাঙ্গনের গেটের পাশে রোপণ করা হয়েছে ‘পিগমি খেজুর’ গাছ।
প্রবীণাঙ্গন তৈরি প্রসঙ্গে পৌর মেয়র আলহাজ মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা আমাদের দেশের সম্পদ। কিন্তু অধিকাংশ পরিবারে প্রবীণরা প্রায় অচ্যুত। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারে জ্যেষ্ঠ বা প্রবীণদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ফলে দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে বৃদ্ধনিবাস। একজন মানুষ তার জীবন-যৌবন পরিবার ও সমাজের জন্য উৎসর্গ করার পরও, অনেক সময় দেখা যায় বৃদ্ধকালে কেউ তার দায়িত্ব নিতে চায় না।
বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে রাখা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই পত্রিকার পাতায় স্থান পায়। অথচ আমাদের সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা একটা সময় অমানুষিক পরিশ্রম করেন সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের জন্য। প্রকৃতির নিয়মে আজ তারা বৃদ্ধ। এখন তাদের হাতে অফুরন্ত সময়। অনেকেই ঘরে বসে থাকেন, অবসাদে কাটে তাদের দিন। বয়সের ভার, বার্ধক্যজনিত রোগ-ব্যাধিও বাসা বাঁধে শরীরে। তাদের নির্মল আড্ডার স্থানটিও সংকুচিত। যদিও এই বয়সে তাদের আরও বেশি নিকটজনের সঙ্গ ও সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যান্ত্রিক জীবনে সবাই নিজ নিজ পরিসরে ব্যস্ত।
এ বিষয়টি আমাকে ভাবায়। আমি পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরপরই চিন্তা ছিল শহরে এমন একটি স্থান করব, যেখানে আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকরা আসবেন, বসবেন, হাঁটবেন, ঘুরবেন, বই পড়বেন, টেলিভিশন দেখবেন, বিশ্রাম নেবেন, নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করবেন। সেই চিন্তা থেকে প্রবীণাঙ্গন তৈরি।’
শহরের কুসুমবাগ এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। নিয়মিত আসেন প্রবীণাঙ্গনে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে সদস্য চারজন। দুই ছেলে প্রবাসী। ছেলের বউরা ব্যস্ত। এক নাতি, সে আছে তার কলেজ আর খেলাধুলা নিয়ে। আমি ঘরে প্রায় বন্দিদশায় ছিলাম। প্রবীণাঙ্গন চালু হওয়ার পর প্রায় দিনই এখানে এসে সময় কাটিয়ে যাই। অনেকের সাথে দেখা হয়, আড্ডা হয়। নির্মল প্রাণোচ্ছল আড্ডা শেষে ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ফিরতে পারি।’
মৌলভীবাজারের প্রবীণ নাগরিক, গণমাধ্যমকর্মী বকসী ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘প্রবীণরা দেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাড়ছে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা। এসব প্রবীণ নাগরিকের জন্য পৌর মেয়র যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রবীণাঙ্গনে গেলে আমাদের বয়সি বা আরও বেশি বয়সিদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, আড্ডা হয়। প্রায় দিনই শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। অথচ আগে এক শহরে থাকলে কারও কারও সঙ্গে দেখা হতো কয়েক মাস পর।’
মৌলভীবাজার জেলা বারের প্রবীণ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী কিশোরী পদ দেব (শ্যামল) বলেন, ‘প্রবীণাঙ্গন পৌর মেয়রের অত্যন্ত রুচিশীল ও সুদূরপ্রসারী একটি কাজ। শুধু পৌর এলাকার প্রবীণরা নন, বিভিন্ন উপজেলা থেকেও অনেক মানুষ এখানে আসেন। প্রাঙ্গণের মনোমুগ্ধকর ফুলবাগান শুধু প্রবীণদের নয়, সকল বয়সের মানুষের হৃদয় হরণ করেছে।’