ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩ ১৩:৩৬ পিএম
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের দেউন্দি চা-বাগানে স্থাপিত চা-শ্রমিকদের মুল্লুক চলো ভাস্কর্য। প্রবা ফটো
উন্নত জীবনযাপনের প্রলোভনে জন্মভিটা ছেড়ে চা বাগানে কাজ করতে আসে একদল মানুষ। কিন্তু কাজে এসে তাদের স্বপ্ন ভেঙে যায়। স্বপ্নভঙ্গের জ্বালা নিয়ে তারা ফিরে যেতে চান নিজ দেশে। এজন্য ডাক দেওয়া হয় ‘মুল্লুকে চলো (দেশে চলো)’ আন্দোলনের।
১৯২১ সালের ২০ মে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ও চা বাগানের মালিকপক্ষ চাঁদপুর জাহাজ ঘাটে চা শ্রমিকদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। চা শ্রমিকদের রক্তাক্ত পরিণতিতে মুল্লুকে ফেরার স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়। রক্তেভেজা এ দিনটিকে (২০ মে) চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা বাগান তৈরি শুরু করে। সিলেট ও আসামের বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চা বাগান করতে প্রয়োজন হয় শ্রমিকের। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এমন পরিশ্রমে অনাগ্রহী ছিলেন। সুন্দর ও উন্নত জীবনের প্রলোভনে দালালের মাধ্যমে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের ওড়িশা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্য প্রদেশের অভাবপীড়িত ও অনুর্বর অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া দলিত এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনও পাড়ি জমায় সিলেট এবং আসাম অঞ্চলের চা বাগানে।
বনজঙ্গলঘেরা পাহাড়ে শ্রম দিতে এসেই বাস্তবতা বুঝতে পারলেন। হিংস্র প্রাণী ও বিষাক্ত পোকামাকড়ের সঙ্গে লড়াই ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মালিকের দেওয়া ছোট এক কুটিরে সপরিবারে বসবাস করতে হতো চা শ্রমিকদের। দিনের পর দিন বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে শুকিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হতো। বাগানের বাইরে যাওয়া ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ। পারিশ্রমিক হিসেবে ‘টি-টোকেন’ নামক এক ধরনের ধাতব বস্তুর মাধ্যমে শুধু চা বাগানের অভ্যন্তরে নির্ধারিত দোকান থেকেই কেনাকাটা করতে পারতেন। এ ছাড়া কারণে-অকারণে চা শ্রমিকদের ওপর চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এতে করে চা শ্রমিকদের সুন্দর ও উন্নত জীবনের প্রলোভনের মোহ কেটে যায়।
আসাম লেবার এনকোয়েরি কমিটির ১৯১৯-২১ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সময়কালে বিভিন্ন কারণে লক্ষাধিক চা শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। যাদের অধিকাংশই অপুষ্টিজনিত ও সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। চা বাগানে শ্রমিকদের বিদ্রোহ প্রকট আকার ধারণ করে। ভারতবর্ষজুড়ে তখন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের তৎপরতা, খেলাফত আর অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাপের ঢেউ।
১৯২০ সালে চা বাগানে টি টোকেন প্রথা বাতিল করে দৈনিক হাজিরা কমিয়ে তিন আনা করা হলে শ্রমিকরা মেনে নিতে পারেননি। ওই বছরের বিভিন্ন সময়ে করিমগঞ্জ, ধলই, কাছাড় ভ্যালি, ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি ও সিলেট ভ্যালির বিভিন্ন চা বাগানে অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। শ্রমিকরা গোপনে নিজ মুল্লুকে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২১ সালে দিনক্ষণ ঠিক করে কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক মুল্লুকে চলো আন্দোলনের ডাক দিয়ে পথে নামেন।
চা শ্রমিকরা যখন করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে এসে পৌঁছলেন, তখন তাদের জানিয়ে দেওয়া হলো ধর্মঘট চলছে। এ অবস্থায়ও পণ্ডিত দেওশরন এবং পণ্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিতের নেতৃত্বে ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নিলেন হেঁটেই দেশে ফিরবেন। খাদ্য ও পানির অভাবে পথে পথে মৃত্যু হয় অনেক শ্রমিকের। তবু থেমে থাকেনি তাদের মুল্লকে চলার সংগ্রাম।
আসাম থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক করিমগঞ্জ, বদরপুর, কুলাউড়া হয়ে হবিগঞ্জে পৌঁছয়। হবিগঞ্জের তৎকালীন কংগ্রেস নেতা শিবেন্দ্র বিশ্বাসের নেতৃত্বে কর্মীরা পথে পথে শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ ও রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় স্বদেশি কর্মীরাও শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
১৯২১ সালের ১৯ মে শ্রমিকরা গিয়ে পৌঁছেন চাঁদপুর জাহাজ ঘাটে। ২০ মে চাঁদপুর মহকুমার প্রশাসক সুশীল কুমার সিংহের নেতৃত্বে রাতে জাহাজে উঠতে থাকা শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গুর্খা সৈন্যরা। জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দিলে শত শত শিশু, বৃদ্ধ ও নারী-পুরুষ মেঘনার জলে ভেসে যায়। সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং বেয়নেট চার্জ করে। এ দিন কয়েক হাজার শ্রমিক নিহত হন। শ্রমিকের রক্তে লাল হয়ে ওঠে মেঘনার জল।
যে মেঘনার জল চা শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সেই মেঘনা পাড়ে কোনো স্মৃতিচিহ্নই নেই। সেখানে গড়ে ওঠেনি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। তবে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের দেউন্দি চা বাগানের শ্রমিকদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে মুল্লুকে চলো ভাস্কর্য। এ ছাড়া ২০০৮ সাল থেকে দেশের প্রায় সব চা বাগানের শ্রমিকরা অস্থায়ী বেদি নির্মাণ করে দিনটিকে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রামভজন কৈরি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘মুল্লুকে চলো আন্দোলনের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করে বারবার দাবি জানানোর পরও দিবসটির স্বীকৃতি মেলেনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালনের কোনো উদ্যোগ নেই। এখনও ঘোচেনি চা শ্রমিকদের বঞ্চনা।’