ঝাড়ুর গ্রাম তিলাইপাড়া
প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৩ ১১:৪১ এএম
বাড়ির উঠানে বসে কুশখড় দিয়ে ঝাড়ু তৈরি করছেন হিমতি কর্মকার
‘বিয়ে হয় প্রায় ২৩ বছর আগে। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসে শাশুড়ির কাছে শিখি কুশখড় দিয়ে ঝাড়ু বানানো। সেই ঝাড়ু বানিয়েই এখন চলে নিজ সংসার, দিয়েছি বড় মেয়ের বিয়ে। এ ছাড়াও যা আয় হয় তা দিয়ে মেয়ে ও ছেলের পড়াশোনা চালাচ্ছি। এক কথায় এই ঝাড়ু বিক্রির অর্থ দিয়েই চলে আমার পুরো সংসার। লাভ কম, তবু যা আয় হয় তা দিয়ে ভগবানের কৃপায় পার হয় দিন’- কথাগুলো দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের তিলাইপাড়া গ্রামের হিমতি কর্মকারের (৪০)।
হিমতি কর্মকারের স্বামী ধরণী কর্মকারও এই পেশায় আছেন। শুধু তারাই নয়, জসিম হাসদা, পুতুল হাসদা, রমণী কর্মকার, প্রদীপ কর্মকার, পরিমল সরকার ও রোজিনা কর্মকারসহ সেই গ্রামের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি ঘরের মানুষের একমাত্র পেশা এই ঝাড়ু তৈরি। তাই আশপাশের মানুষ সেই গ্রামটিকে বেশি চেনে ঝাড়ুর গ্রাম নামেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির সামনে নিজ নিজ উপকরণ নিয়ে বসে ঝাড়ু বানাচ্ছেন ওই গ্রামবাসীরা। ঠিক তেমনি বাড়ির আঙিনায় স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঝাড়ু বানাচ্ছিলেন হিমতি কর্মকার। তাদের মধ্যে কেউ কুশখড়গুলো বেছে রাখছিলেন, কেউ সোজা করছিলেন। আবার কেউ সেগুলো বেঁধে ঝাড়ুতে রূপান্তিত করছিলেন। তাদের আঙিনাজুড়ে ছিল কুশখড় আর তৈরি হওয়া ঝাড়ু।
জানা যায়, হিমতি কর্মকার তিন সন্তানের জননী। তার বড় মেয়ে রানী কর্মকারকে এই পেশা থেকে সঞ্চিত কিছু অর্থসহ ধারদেনা করে ২০১৬ সালে বিয়ে দেন। ছোট মেয়ে কণিকা কর্মকার। সে ফুলবাড়ী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলে রুমন কর্মকার। সে একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কণিকা কর্মকার ও মন কর্মকারও লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবা-মাকে ঝাড়ু বানাতে সাহায্য করে। তাদের পাশাপাশি পুরো গ্রামের মানুষ যেন এই পেশাতেই জীবিকা নির্বাহ করছে।
হিমতি কর্মকার বলেন, ‘আমরা এই ঝাড়ু বানিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছি। আমাদের বাড়তি আয়ের আর কোনো পথ নেই। এই গ্রামে সবাই ঝাড়ু বানায়। সেই ঝাড়ু বিভিন্ন স্থানে পাইকারি বিক্রি করা হয়। ঝাড়ুর জন্য প্রয়োজনীয় কুশখড় দিনাজপুর, বিরামপুর, ফুলবাড়ীর বিভিন্ন বর্ডার এলাকা থেকে সংগ্রহ করি। পরে সেগুলো ঝাড়ুর জন্য উপযুক্ত করে তুলে ঝাড়ুগুলো তৈরি করি। আমরা প্রতিদিন প্রায় ৫০টা ঝাড়ু তৈরি করতে সক্ষম হই। সে ঝাড়ুগুলো প্রতিপিস পাইকারি ২০ টাকা মূল্যে বিক্রি করা হয়।’
হিমতি কর্মকার স্বামী ধরণী কর্মকার বলেন, ‘এই গ্রামের ৩০ থেকে ৩৫ ঘর আমরা সবাই ঝাড়ু তৈরি করি। বিভিন্ন স্থান থেকে লোক এসে আমাদের কাছ থেকে পাইকারি মূল্যে ঝাড়ু কিনে নিয়ে যান। সেই ঝাড়ু বিক্রির টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে হয়।’
ঝাড়ু তৈরিকারী পুতুল হাসদা, প্রদীপ কর্মকার ও রোজিনা কর্মকার জানান, ‘ঝাড়ু তৈরি করতে অনেক কষ্ট। কুশখড় সংগ্রহ করা মুশকিল। বর্ডার এলাকা ছাড়া পাওয়া যায় না। ঝাড়ু পাইকারি মূল্যে বিক্রি করলে কম লাভ হয়। অনেকে সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন হাটবাজারে খুচরা মূল্যে বিক্রি করি। পাইকারি বিক্রি করলে পাওয়া যায় ২০ টাকা আর খুচরা ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করা যায়।’
ফুলবাড়ী বাজারে কুশের ঝাড়ু বিক্রেতা মো. সোলাইমান ও আহম্মদ আলী বলেন, ‘শিবনগর থেকে পাইকার মূল্যে কুশখড়ের এই ঝাড়ুগুলো দিয়ে যান- যারা এগুলো তৈরি করে। আমরা বাজারে ৪০ টাকা করে ঝাড়ুগুলো বিক্রি করি। প্রতি পিস ঝাড়ু বিক্রিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা লাভ হয়।’