বগুড়ায় অধ্যক্ষ পান্না হত্যাকাণ্ড
বগুড়া অফিস
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৩৮ পিএম
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:৪৮ পিএম
নিহত অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রেজাউল করিম পান্না। সংগৃহীত ছবি
বগুড়ায় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রেজাউল করিম পান্না হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেপ্তার খায়রুল হাসান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও তা বিশ্বাস করছেন না নিহতের স্বজনরা। তারা বলছেন, হত্যার সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষ জড়িত রয়েছে।
খায়রুলের স্বজনরাও বলছেন, জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
পুলিশও হত্যার কারণ নিশ্চিত হতে পারেনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বগুড়া সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রুম্মান হাসান জানিয়েছেন, খায়রুলের আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলেও সে মাদকাসক্ত নয়। এমনকি তার বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার কোনো রেকর্ডও নেই।
তিনি বলেন, ‘খায়রুল ১৬৪ ধারায় আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছে, সেটি সম্পর্কে এখনও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে তা ভিত্তি ধরে আপাতত আমরা তদন্ত চালিয়ে যাব। তদন্তে নতুন কিছু পেলে তাকে রিমান্ডে নিয়ে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করব।’
গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে শহরের নিউ মার্কেট থেকে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে থানা মোড়ের সামনে রেজাউল করিম পান্নাকে ছুরিকাঘাত করে খায়রুল। বাধা দেওয়ায় এক পথচারী ও দুই পুলিশ সদস্যকেও সে ছুরিকাঘাত করে। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় খায়রুলকে আটক করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অধ্যক্ষ পান্না মারা যান।
রেজাউল করিম পান্না বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ২০১৩ সালে তিনি অবসর নেন।
গ্রেপ্তারের পর খায়রুল প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাতে সে দাবি করে, শিক্ষক রেজাউল করিম পান্না ও তার ছেলে বিভিন্ন সময় তাকে নির্যাতন করত। তার জায়গা কেনা এবং বাড়ি করার বিষয়টিও তারা সহজভাবে নিতে পারেননি। তার অভিযোগ, রেজাউল করিম পান্নার কারণে ফুলবাড়ী এলাকায় সে ভালোভাবে বসবাসও করতে পারেনি। সেই রাগ থেকে সে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
অধ্যক্ষকে হত্যার পর তার ছেলে আবু রেজা আল মামুন সদর থানায় মামলা করেন। মামলার একমাত্র আসামি খায়রুল। তার বাড়িও বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকায়। তবে ৪ বছর আগে তিনি বাড়ি বিক্রি করে ভবঘুরে হয়ে যান।
খায়রুলের স্বজনদের দাবি, প্রায় ৪ বছর ধরে সে মানসিক রোগে ভুগছে। দুই বছর আগে সে তার বাবা ও ভগ্নিপতিকেও হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে।
খায়রুল একসময় স্বর্ণশ্রমিক ছিল। সে সিরাজগঞ্জে কাজ করত। পনেরো বছর আগে সে ফুলবাড়ী এলাকায় ৬ শতাংশ জায়গা কিনে এক তলা বাড়ি নির্মাণ করে। সেখানে তার বাবা-মা থাকত।
খায়রুলের খালা ফাতেমা বেগম জানান, বাড়ি নির্মাণের কয়েক বছর পরই তার ভাগ্নের মস্তিষ্কে বিকৃতি দেখা দেয়। সে বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে বিক্রি করা শুরু করে। করোনা শুরুর এক বছর আগে সে ৩৮ লাখ টাকায় বাড়িটি বিক্রি করে ভবঘুরে হয়ে যায়। তখন খায়রুলের বাবা-মা, বোন ও ভগ্নিপতি পাশের একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠে। দুই বছর আগে হঠাৎ খায়রুল সেই ভাড়া বাড়িতে এসে বাবা ও ভগ্নিপতিকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এরপর তার বাবা-মা সিরাজগঞ্জে মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে চলে যায়।
তিনি বলেন, ‘খায়রুল একসময় নামাজি ছিল। হঠাৎ করে কীভাবে তার মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটে, সেটা আমরাও বুঝতে পারিনি। যে কারণে সে বিয়েও করেনি।’
খায়রুলের দেওয়া জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য নয় উল্লেখ করে খালা ফাতেমা বেগম ও মামি শান্তনা খাতুন বলেন, রেজাউল করিম পান্না ভালো মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে খায়রুলের বিরোধ তো দূরের কথা কোনো যোগাযোগই ছিল না। তা ছাড়া খায়রুল অনেক আগে থেকে এলাকাছাড়া। সে কখন কোথায় থাকে, তা আমরা কেউ জানি না।
একই বক্তব্য দিয়েছেন অধ্যক্ষ পান্নার ছেলে আবু রেজা আল মামুন। তিনি বলেন, ‘খায়রুলকে আমার আব্বা কিংবা আমরা কেউ চিনতাম না। তৃতীয় কোনো পক্ষ খায়রুলকে দিয়ে বাবাকে হত্যা করিয়ে থাকতে পারে।’
পুলিশ কর্মকর্তা রুম্মান হাসান জানান, গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে পাঠানোর আগ পর্যন্ত প্রায় ১৬ ঘণ্টা খায়রুল তাদের হেফাজতে ছিল। এ সময়ে তাকে মাদকাসক্ত বলে মনে হয়নি। সে কোনো মোবাইলও ব্যবহার করত না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন খায়রুল একেক দিন একেক আবাসিক হোটেলে অবস্থান করত।
তিনি বলেন, ‘জবানবন্দির বক্তব্য সম্পর্কে আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। তার দেওয়া তথ্যগুলো যাচাই করার জন্য অধিকতর তদন্ত শুরু করব। যদি কোনো অসঙ্গতি পাই তাহলে রিমান্ডে নেওয়া হবে। তাকে কেউ ব্যবহার করেছে কি না, সেটাও জানার চেষ্টা করব।’