সুফল চাকমা, বান্দরবান
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ০১:০১ এএম
ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই উৎসবের শোভাযাত্রায় অংশ নেয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রবা ফটো
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সপ্তাহজুড়ে তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব উদযাপন করছেন। পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করছেন তারা তাদের নিজস্ব রীতিতে। এসব উৎসব কোনো কোনো জাতিসত্তা ১২ এপ্রিল আর অন্যরা ১৩ এপ্রিল শুরু করেছেন। সবার উৎসবেই রয়েছে ফুল সংগ্রহ, নানা রকম খেলাধুলা, অতীতের গ্লানি ভুলে নতুন আশা, অতীতের অন্যায়ের জন্য সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা ও সৌহার্দ্য বিনিময়, ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন করা, প্রবীণদের আশীর্বাদ নেওয়া, ভাল খাবারদাবারের আয়োজন ইত্যাদি।
মাহা সাংগ্রাইং পোয়ে
মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব ‘মাহা সাংগ্রাইং পোয়ে’ শুরু হয়েছে ১৩ এপ্রিল। উৎসব উপলক্ষে তারা হরেক রকম ফুলের সমারোহে সাজিয়ে তোলে ঘরদোর, বৌদ্ধ বিহারগুলো। বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধস্নান শেষে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন প্রকারের পিঠা তৈরির উৎসব আর সন্ধ্যা হলেই নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাহাড়িদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে মারমাদের পানি ছোড়া উৎসব ও তৈলাক্ত বাঁশ আরোহণ। মারমা তরু-তরুণীরা পরস্পরকে পানি ছিটিয়ে বরণ করে নেন নতুন বছর। সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে শেষের দুই দিন পানি বর্ষণ উৎসব হয়।
বিঝু
চাকমাদের প্রধান উৎসব বিঝু। শুরু হয়েছে ১২ এপ্রিল। তরুণ-তরুণীরা ভোরে বন থেকে বিঝু ফুল ও অন্যান্য বুনোফুল সংগ্রহ করে নদীতে ভাসায়। পুরনো বছরের দুঃখ-কষ্ট মুছে যাওয়া ও নতুন বছর যেন নতুন প্রত্যাশা অনুযায়ী সুখের, আনন্দের হয় সেই কামনায় প্রার্থণা করেন। ঘরের দরজায় বিভিন্ন ফুল দিয়ে সাজিয়ে তোলেন তারা। ঘরের সবকিছু ধুয়েমুছে পরিচ্ছন্ন করে তোলেন গৃহস্থরা। ঘরে ঘরে বিভন্ন প্রকার পিঠা তৈরি হয়। অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। চাকমাদের পাজন তরকারি খুবই জনপ্রিয়। হরেক রকম সবজি দিয়ে এই তরকারি রান্না করা হয়। বিভিন্ন পিঠার সাথে পাজন পরিবেশন করা হয়। অতীতের ঝগড়া-বিবাদ ভুলে একে অপরে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। সাধ্য অনুযায়ী পাড়ার বয়স্ক, প্রবীণ ও অন্য আপনজনদের ভালো খাবার পরিবেশন করা হয়। কথিত আছে, নতুন বছরে ভালো খাবার পরিবেশন করলে মুরব্বিদের আশীর্বাদ মেলে। সারা বছর এ রকম খাবার পাওয়া যায়। ঘরে সুখশান্তি বিরাজমান থাকে। তিন দিন ধরে তারা এই উৎসব করেন।
সাংগ্রাইং
চাকরা নববর্ষ উৎসবকে সাংগ্রাইং বলে। বার্মিজ বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে এই উৎসব তিন দিন ধরে উদযাপন করেন তারা। উৎসবের প্রথম দিনকে পাইংছোয়েক বলেন। এই দিন যুবক-যুবতীরা জঙ্গল থেকে নাগেশ্বর ফুল তুলে বিকালে বিহারে গিয়ে পূজা দেন; মোমবাতি জ্বালিয়ে পুণ্য অর্জনের জন্য প্রার্থনা করে থাকেন। বয়স্করা অষ্টশীল গ্রহণ করে বিহারে অবস্থান করেন। শীলগ্রহণকারীদের পাড়ার যুবক-যুবতী ও শিশুরা প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। সারা রাত পিঠা বানিয়ে দ্বিয় দিন বুদ্ধ, ভান্তে ও শীলগ্রহণকারীদের পূজা দিয়ে থাকে। খুব ভোরবেলায় স্নান করে বিহারে যায় শিশুসহ সব বয়সীরা। সকালে আহারের পর ভান্তে ও শীলগ্রহণকারীদের স্নান করিয়ে আর্শীবাদ গ্রহণ করে। দুপুরে পাড়াবাসী মিলে সংঘদানের আয়োজন করে। বিকালে বিহারে গিয়ে পঞ্চশীল নিয়ে আশীবাদ গ্রহণ করে। তৃতীয় দিন পাড়ায় পাড়ায় মুরব্বিদের স্নান করিয়ে আর্শীবাদ গ্রহণ করে এবং যুবক-যুবতীরা পরস্পরকে পানি ছিটিয়ে নিজের মায়া-মমতা ও আবেগ প্রকাশ করে। তার পরের দিন থেকে বিহারে বিহারে বুদ্ধ বিম্বকে স্নান করিয়ে পুণ্য অর্জন করে।
বৈসুক
ত্রিপুরারা তিন দিনব্যাপী বৈসুক উদযাপন করেন। প্রথম দিন সকালে ফুল দিয়ে গঙ্গা পূজা করে সকলের মঙ্গল কামনা করা হয়। ত্রিপুরাদের এতিহ্যবাহী গড়াইয়া নৃত্যে ২২ জনের পুরুষের দল থাকে, যারা গ্রামজুড়ে বাজনার তালে নেচেগেয়ে সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখেন সপ্তাহজুড়ে। শেষ দিন যুবক-যুবতীরা বয়স্কদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। তারা দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন পিঠাসহ নানা রকম খাওয়াদাওয়া হয়।
বিষু
তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান উৎসব বিষু। তরুণ-তরুণীরা আনন্দ প্রকাশ করে ঘিলা খেলাসহ ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে। সবশেষে বৌদ্ধ বিহারে সকলের জন্য মঙ্গল কামনা করা হয়। ঘিলা খেলার সঙ্গে তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রেম-ভালবাসা ও আনন্দ-বেদনার স্মৃতি জড়িয়ে থাকে।
চাংক্রান পোয়ে
বর্ষ বরণকে ম্রো ভাষায় বলা হয় ‘চাংক্রান পোয়ে’। তারা জাঁকজমকপূর্ণভাবে বর্ষবরণের উৎসব পালন করে থাকেন। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধমার্বলম্বী ম্রোরা ভোরে বুনো ফুল সংগ্রহ করে ঘরদোর সাজিয়ে তোলেন। পরদিন বিহারে গিয়ে চন্দন ও ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ মূর্তি স্নান করান। এরপর পঞ্চশীল ও অষ্টশীল প্রার্থনায় বসেন তারা। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের দিনে এই উৎসব আয়োজন করা হচ্ছে।
সাংলান
খেয়াংদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব সাংলান। বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান, ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পালন করেন তারা এ দিনটি। বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষু ও অষ্টশীলধারীদের পিঠা ভোজন করানো হয়।
সাংক্রাই
খুমিদের প্রধান উৎসব সাংক্রাই। প্রথম দিন (১৩ এপ্রিল) সকালে থালাবাসন, কাপড়চোপড়, ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পর দলবেঁধে জঙ্গলে বিভিন্ন তরিতরকারি খুঁজতে যার খুমিরা। পরদিন খুব ভোরে প্রত্যেক বাড়ির উঠানে হাস মুরগির জন্য ভুট্টা ছিটিয়ে দেন তারা। তারপর গ্রামের মুরব্বিদের জন্য কলাগাছের পাতায় মোড়ানো উন্নত খাবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। বিকেলে বাঁশের খড়ম দিয়ে হাঁটা, ঘিলা খেলাসহ বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। শেষ দিন যুবক-যুবতীরা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহ করেন; বিকেলে তারা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
এবারও এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষেরা এভাবেই তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব উদযাপন করছেন।