আমিনুল ইসলাম মিঠু, সুন্দরবন থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৪:৩৭ পিএম
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৬:০১ পিএম
কোকিলমনির ফরেস্ট অফিসের পাশে আবর্জনার মাঝে চিত্রা হরিণ। ছবি: আদনান আজাদ আসিফ
গত ১৪ মার্চ সকালে খুলনা নদীবন্দর থেকে জাহাজে সুন্দরবনে যাওয়ার পথে একে একে সাতবার ইরাবতী ডলফিন লাফিয়ে উঠতে দেখে যায়। একইভাবে পশুর এবং শ্যালা নদীতেও ডলফিনের খেলা দেখা গেছে। মাঝে একবার মনে হলো শুশুকের মতো কিছু ভাসছে। কিন্তু কাছে যেতেই বোঝা গেল শুশুক না, তা প্লাস্টিকের বোতল। একটু পর মনে হলো সাদা ডলফিন ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে কাছে আসতেই ভ্রম কেটে যায়। আসলে সেগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেট, গ্লাসসহ নানা উপকরণ। ওই তিন নদী ছাড়াও সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল, এমনকি জঙ্গলের ভেতর প্রাকৃতিক জলাশয়, পুকুরসহ বনের গাছেও দেখা মিলল প্লাস্টিক উপকরণ। শুধু তাই নয়, বানরের হাত ও হরিণের মুখে পলিথিনের প্যাকেট চোখে পড়ে।
বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ আন্দারমানিক ইকো ট্যুরিজম সেন্টার, হারবাড়িয়া পর্যটক স্পট, শরণখোলার কটকা, করমজলের কুমির প্রজননকেন্দ্র এলাকাসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্লাস্টিক উপকরণে সয়লাব। এমনকি সংরক্ষিত বন ও বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এলাকাও বাদ যায়নি। সুন্দরবনের জামতলি সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিক বর্জ্য। জোয়ারে অগণিত প্লাস্টিক উপকরণ বনের গহিনেও ছড়িয়ে আছে।
জানা যায়, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ৬ লাখ পর্যটক সুন্দরবনে বেড়াতে যায়। প্রতিদিন ৫০-৭৫ জন পর্যন্ত ধারণক্ষমতার ২০টি জাহাজ ঢুকে সুন্দরবনে। এ ছাড়া স্পিডবোট, ইঞ্জিনচালিত নৌযান, হাউস বোটেও অনেকে আসেন। সম্প্রতি সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দূষণ জরিপ করে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক। ওই সময় জামতলা সৈকত থেকে প্রায় চার কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন তারা।
জানতে চাইলে এমভি আদিবা জাহাজের মাস্টার আলম হোসেন বলেন, ‘আগে এত পর্যটকও যেত না। জাহাজও চলত না। এখন মানুষের সৌখিনতা বেড়েছে। তাই প্রতিবছর পর্যটক বাড়ছে। জাহাজ থেকে যাতে কোনো বর্জ্য না ফেলে সেজন্য নির্দেশনা দিই। কিন্তু অনেকেই মানেন না।’
সুন্দরবনের পর্যটন ব্যবসায়ী তাওহীদুল ইসলাম শাওন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকার যদি কঠোরভাবে নির্দেশ দিত তবে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার সুন্দরবনে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে। তবে আমাদের মধ্যে অনেকে পর্যটকদের প্লাস্টিক বোতল, প্লেট ব্যবহারে নিরুৎসাহী করি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পর্যটকরা সচেতন না থাকার কারণে দূষণ হয়ে থাকে।’
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান, গত ২১ ফেব্রুয়ারি ৬০টি জাহাজে এবং ১৬ ডিসেম্বর ৪২টি জাহাজে পর্যটক আসে সুন্দরবনে। এ সময় কমপক্ষে একবার ব্যবহার্য দুই হাজার প্লাস্টিকের পানির বোতলের বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে বনের বিভিন্ন স্থানে ফেলেছে পর্যটকরা। অথচ উপকূলে প্লাস্টিক পণ্য বিক্রিতে রয়েছে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা।
পশুর ও শ্যালা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে পানির গুণগত মান যাচাইয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন স্ট্যামফোর্ডের গবেষকরা। এ সময় নদীর পানির ফিজিক্যাল, কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল প্যারামিটার নিরীক্ষা করা হয়। এতে শ্যালা নদীর পানিতে ঘনীভূত অক্সিজেন ছিল ৩ দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। কিন্তু এই নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্য আদর্শ মানমাত্রা কমপক্ষে ৫ মিলিগ্রাম।
গবেষক দলের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক দূষণে বিপর্যস্ত খুলনার রূপসা, পশুর ও শ্যালা নদী।
জরিপকালে প্রতি ঘণ্টায় শতাধিক পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পাওয়া যায়। মূলত সেগুলো বিভিন্ন নৌযান থেকে ফেলা হয়েছে। তবে বিশাল নদী ও বন থেকে যে পরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, তা মোট প্লাস্টিকের ১০ শতাংশ। এসব প্লাস্টিক উপকরণ পানিতে মিশে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়; যা জলজ পরিবেশ ও প্রাণীর জন্য মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর।’
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক গুলশান আরা লতিফা বলেন, সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ ও বানরসহ বিভিন্ন প্রাণীর বিচরণ রয়েছে জামতলি সৈকতে। অথচ এখানে এসে পর্যটকরা বিভিন্ন প্লাস্টিক আবর্জনা ফেলছে। সাধারণত প্রাণীরা এসব প্লাস্টিকের মোড়কে মজাদার খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে নিজের খাবার মনে করে খেয়ে নেয়, যা তাদের পেটে গিয়ে আটকে যায়। অনেক প্রাণী মারা যায়। তা ছাড়া এখানে ফেলা প্লাস্টিক সমুদ্রেও যায়। এতে সেখানকার প্রতিবেশও নষ্ট হয়। মাছের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর উপাদান মানুষেরও পেটে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকলে তা ছোট ছোট টুকরো বা খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তা ডলফিন, শুশুক, কুমিরসহ মাছ প্রজাতি খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্লাস্টিক টুকরো পেটে আটকে জলজ প্রাণী মারা যেতে পারে। সম্প্রতি ব্রাজিলের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ফুড সেফটি অ্যন্ড কোয়ালিটি ডিভিশনের এক যৌথ গবেষণা ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। গবেষণায় দেখা যায়, সুন্দরবনসংলগ্ন পশুর নদী, মোংলা নদী ও রূপসা নদীর ১৭ প্রজাতির মাছ মাইক্রোপ্লাস্টিকে সংক্রমিত। গবেষণাপত্রে বলা হয়, প্লাস্টিক দূষণের ফলে সামুদ্রিক মাছ এখন হুমকির মুখে। আর মাইক্রোপ্লাস্টিকে সংক্রমিত মাছ খেলে লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্লাস্টিক দূষণ পুরো সুন্দরবন এবং এ বনের প্রাণীর জন্যই ক্ষতিকর। আর জলজ পরিবেশে কোনো প্লাস্টিক বোতল বা উপকরণ ফেলা হলে সেগুলো ছোট ছোট টুকরো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হচ্ছে। এতে সেগুলো মাছ খাচ্ছে, আবার সে মাছ ডলফিন ও কুমিরের মতো জলজ প্রাণীরাও খাচ্ছে। যা জলজ বাস্তুতন্ত্রের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। তা ছাড়া প্লাস্টিক পণ্য জোয়ার-ভাটার কারণে বনের ভেতরে যেমন যাচ্ছে; তেমনি বঙ্গোপসাগরে গিয়েও পড়ছে। ফলে সাগরের জলজ প্রাণীর পেটেও যাচ্ছে এসব বর্জ্য।
গত ফেব্রুয়ারিতে সায়েন্স ডাইরেক্ট জার্নালে মাইক্রোপ্লাস্টিসিস ইন ডিফারেন্ট ফিশ অ্যান্ড সেলফিশ স্পেসিস ইন টি ম্যানগ্রোভে এস্টুয়ারই অব বাংলাদেশ অ্যান্ড অ্যাভালুয়েশন অব হিউমান এক্সপোজার প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের নদী থেকে সংগ্রহ করা ২৫ প্রজাতির মাছ ও দুই প্রজাতির চিংড়িতে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। এরমধ্যে ইলিশ, লইট্টা, ভেটকি অন্যতম। মাছের মাংসে সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৩৭ থেকে সর্বোচ্চ ৫৪ দশমিক ৩০ মাইক্রোপ্লাস্টিক টুকরো পাওয়া গেছে। নাড়িভুড়িতে সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ৩৩ থেকে ২০৫ দশমিক ৬ মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরো পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ২০২২ সালের অক্টোবরে ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সুন্দরবনের তিনটি প্রধান নদীর অন্তত ১৭ প্রজাতির মাছ ও তিন প্রজাতির শেলফিশে মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করার বিষয় তুলে ধরা হয়।
গবেষণাটির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘মানুষ সাধারণত মাছের মাংস খেয়ে থাকে। গবেষণাটিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক টুকরো উদ্বেগজনক হারে পাওয়া গেছে। তবে সব থেকে ভয়াবহ বিষয় হলো জলজ প্রাণীরা মাছের নাড়িভুড়িসহ খেয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত মিলেছে। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকযুক্ত মাছ জলজ ও স্থল বিভিন্ন প্রাণী খেলে কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সুন্দরবনের আশপাশের নদীগুলো থেকে পানি নিয়ে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, ‘প্লাস্টিক বা মাইক্রোপ্লাস্টিক ডলফিন, শুশুক বা জলজ প্রাণীতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে; তা নিয়ে গবেষণা হয়নি। তবে কয়েকটি গবেষণায় সুন্দরবনের নদীগুলোর মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। উজানের নদীগুলোর প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব সুন্দরবনের নদীতে আসছে। এতে সুন্দরবনের পানিতে প্লাস্টিক দূষণ তীব্র হচ্ছে।’
সম্প্রতি দেশের ৫৬ নদীর স্বাস্থ্য, জলজ চরিত্র নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিভার ও ডেল্টা রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি)। এতে বলা হয়েছে, খুলনা অর্থাৎ সুন্দরবনের উজানে ভৈরব নদী এবং খুলনার রূপসা, পশুর নদীতে প্লাস্টিক দূষণ তীব্র হচ্ছে এবং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। একই সঙ্গে শিল্প ও পৌর বর্জ্যে নদীগুলোর পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে সুন্দরবনের ভেতরের নদীর প্রবাহ টিকিয়ে রাখতে হবে। কারণ সুন্দরবন হচ্ছে কানেকশন অব রিভার্স। তবে সুন্দরবনের আশপাশের নদীতে প্লাস্টিক ও শিল্প দূষণ পাওয়া গেছে। যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। একই সঙ্গে সুন্দরবনে মিঠাপানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে উজানের পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে হবে এবং এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।