দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
মেরিনা লাভলী, রংপুর
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩ ১০:০৪ এএম
আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৩ ১২:৩১ পিএম
বাদাম ক্ষেতের পরিচর্চায় ব্যস্ত কৃষিশ্রমিক মর্জিনা বেগম। ছবি: প্রবা
‘এক বছরোত গরুর মাংস চোখে দেখি নাই বাহে। মাইনষে কোরবানির গোশত দিছিল, সেইটাই খাইছিনু। এ্যালা ব্রয়লার মুরগির গোশত এক পোয়া ৭৫ টাকা। ভূঁইয়োত (ক্ষেতে) কামলা খাটি যে টাকা পাই তা দিয়া চাউল, নুন, ত্যালে কিনি নাকি গোশতই কিনি। ভাত খাওয়ারে অবস্থা নাই, পুষ্টি কই থ্যাকি পাই। হামার চাইর দিন কাম হইলে দশ দিন কাম থাকে না। কেমন করি চলমো। সামনোত আবার ওজা (রোজা) আসতোছে।’
রংপুর গঙ্গাচড়ার উপজেলার তিস্তা নদীর তীরবর্তী গান্নারপাড় এলাকায় বাদামক্ষেত নিড়ানোর সময় কথাগুলো বলছিলেন কৃষিশ্রমিক মর্জিনা বেগম।
আক্ষেপ করতে করতে তিনি বলেন, ‘একটা বেটা আছে, তাইয়ো প্রাইভেট পড়ায়া নিজে লেখাপড়া করতোছে। তার কাছোত কেমন করি দুধ, ডিম, ফলমূল খাবার চাও। ওয় তো নেজেই চলবার পায় না। এল্যা বাজারোত তরমুজ বেড়াইছে, সেই তরমুজ কি হামরা কিনি খাবার পামো।’
একই এলাকার মুদিদোকানি মজিদুল ইসলাম বলেন, ‘দিনোত যা ইনকাম করি, তা দিয়া সংসার চলে না। গরু গোশত ৫শ থ্যাকি ৭শ টাকাত চলি গেইছে। চাউলের কেজি ৬০ থ্যাকি ৬৫ টাকা, মাছ আড়াইশ থ্যাকি ৩শ টাকা, ত্যালের দাম ২শ টাকা লিটার। সউগ কিছুরে দাম বাড়ছে। বাজারের নিয়ন্ত্রণ নাই। বাড়ির শাক-পাতা খ্যায়া হামরা থাকি। সংসার চালায় এখন মুশকিল হয়া গেইছে।’
তিস্তার বিজয় বাঁধ এলাকার মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘চাইল-ডাইলের যে দাম; মাছ, গোশত, ডিম, দুধ তো হামরা খাবার পারি না। বাচ্চারাও পুষ্টি পায় না। অল্প কামাইয়োত তো দামি জিনিস খাওয়া যায় না। বাড়িত ডিম খাবার চাইলে তো একটা কিনি খাওয়া যায় না। চাইরটা নাগে। এ্যালা চারইটা কিনবার গেইলে ম্যালা টাকা খরচ। সরকারও হামাক কিছু দেয় না। কেমন করি চলি হামরা। কয়েকজন টিসিবির কার্ড পাইছে, তাও মাসে একবার করি পায়। সেই ত্যাল, চিনি দিয়া কি চলে। ফলমূল খাবার পাই না, চরের শাকপাতা তুলি নিজেরা খাই, ছাওয়ার ঘরোক খাওয়াই। দেখেন না ছাওয়া কোনা কেমন শুকি গেইছে।’
শুধু মজিদুল-মনোয়ারা নয়, তার মতো ওই অঞ্চলের আরও অনেক মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের দুর্ভোগের কথা জানান।
রংপুর নগরীর আলমনগরের ট্রাকচালক শাকিল হোসেন বলেন, ‘আগে অন্তত শুক্রবারে গরুর গোশত খাইতাম। এরপর গরুর গোস্তের দাম বাড়ায়, মুরগির গোশত খাওয়া শুরু করি। এখন মুরগির গোস্তেরও দাম বেশি। আস্ত ব্রয়লার মুরগি নিলে আড়াইশ টাকা কেজি আর কাটা মুরগির গোশত নিলে সাড়ে ৩শ টাকা কেজি। এখন শুক্রবার আর গোশত খাওয়া হয় না। ডিম দিয়ে খাবার চালিয়ে নিতে হয়। রমজানে ডিমও খেতে পারব কি না সন্দেহ।’
তিনি বলতে থাকেন, ‘ওদিকে আগের মতো ট্রাকের ট্রিপ নেই। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন বসে থাকতে হয়। এর মধ্যে অসুখ-বিসুখ তো লেগেই থাকে। তাই সংসার চালানোই বড় দায় হয়ে পড়েছে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নদীভাঙন ও বন্যার সঙ্গে সংগ্রাম করা চরবাসীসহ রংপুর নগরীর খেটে খাওয়া নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থা করুণ হয়ে পড়েছে। চাল-ডাল, তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েছে হু-হু করে। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বাড়ির কর্তারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে পুষ্টি নিরাপত্তায় পিছিয়ে পড়েছে পরিবারগুলো। ফলে সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তাই খেটে খাওয়া মানুষ এ নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে তেল, চিনি, ডাল, ছোলা স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে ঊর্ধ্বগতির বাজারে ধকল যাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. শাহ মো. সারওয়ার জাহান বলেন, স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ গ্রাম-গঞ্জে থাকে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে টানাপড়েন চলছে। অনেক সময় তারা শিশু-বয়স্কসহ পরিবারের সব সদস্যের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারছে না। পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না, তাদের মেধার বিকাশ ঘটে না। ফলে তারা সমাজে অবহেলিত হয়ে বেড়ে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তাই পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি নিশ্চিতে মাছ-মাংসের বদলে শাক-সবজি, অন্য প্রোটিনযুক্ত খাবার খেতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এসে কীভাবে অন্য খাবারের উৎস থেকে পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়, সেটি জানতে হবে। তাহলে পুষ্টি নিয়ে যে সংকটের শঙ্কা রয়েছে, তা দূর হয়ে যাবে।’
রংপুর জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অসচ্ছল এক কোটি পরিবারকে স্বল্পমূল্যে টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণ করা হচ্ছে। রমজান ঘিরে এক মাসে টিসিবির মাধ্যমে একটি পরিবার দুবার টিসিবির পণ্য পাবে। এ ছাড়া সরকারি অন্য সহযোগিতা নগরের অসচ্ছল পরিবারসহ প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।