× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শিল্পের অরাজকতায় বিপন্ন সীতাকুণ্ড

এস এম রানা, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪৭ এএম

আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৩ ১০:১৮ এএম

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে কারখানার বাইরের চিত্র। প্রবা ফটো

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে কারখানার বাইরের চিত্র। প্রবা ফটো

‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ - সীতাকুণ্ডে গিয়ে প্রায় ৯৫ বছর আগে মুগ্ধ কবি কাজী নজরুল ইসলামের হৃদয় থেকে উঠে এসেছিল এই গানের কলি। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় তথ্য বাতায়নেও লেখা হয়েছে, ‘পাহাড় আর সমুদ্রবেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সীতাকুণ্ড’। যদিও পরিবেশবিদ, পর্যটক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগরগরিবেষ্টিত সীতাকুণ্ডে এখন চলছে শিল্পের ‘অরাজকতা’। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত সীতাকুণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য এখন বিপণ্ন। কাজী নজরুল এখন সীতাকুণ্ডে গেলে তার মনে হয়তো গানের এ বাক্য আসত না, ‘চিতাবাঘ মিতা আমার, গোখর খেলার সাথী’।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সীতাকুণ্ডের যেখানে সেখানে শিল্পকারখানা বসছে। এমনকি কঠোর পাহারায় গোপনে পাহাড় কেটেও স্থাপন করা হচ্ছে এসব কলকারখানা। বায়ু ও শব্দদূষণে অতিষ্ঠ এখানকার জনজীবন। সীতাকুণ্ড এখন হয়ে উঠেছে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ড ও শ্রমিকদের মৃত্যু-উপত্যকা। মরুকরণ প্রক্রিয়ার শিকার এই জনপদ। উপকূলীয় বন কেটে শিপইয়ার্ড তৈরি থেকে শুরু করে এলপিজি কারখানার অবকাঠামোসহ এমন কোনো পরিবেশগত অনাচার যা এখানে হচ্ছে না। এখানে এমন কিছু শিল্প এলাকা গড়ে উঠেছে, যেখানে উপজেলা প্রশাসন এবং শিল্প পুলিশ সদস্যরাও ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারেন না- এতই প্রতাপশালী সীতাকুণ্ডে কারখানা স্থাপনকারী শিল্পোদ্যোক্তারা।

এ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, স্বাধীনতার আগেও সীতাকুণ্ডে জুট মিল, শিপইয়ার্ড ও ইস্পাত কারখানাসহ কিছু কারখানা ছিল। কিন্তু গত দুই দশকে এখানে শিল্প বিস্তৃত হয়েছে দ্রুতগতিতে। সমস্যা হলো, কারখানাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড, শ্রমিকের মৃত্যুসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের বিএম ডিপো, চলতি মার্চ মাসে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট এবং তুলা কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় দেশের মানুষের দৃষ্টি বিশেষভাবে নিবদ্ধ হয়েছে এই জনপদের ওপর। তবে দুর্ঘটনা-মৃত্যু সীতাকুণ্ডে সব সময়ই ছিল এবং আছে।

আরও পড়ুন :  সীতাকুণ্ডে সস্তা শুধু শ্রমিকের জীবন, মৃত্যু ডালভাত

সীতাকুণ্ডে শিল্প প্রসারের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে জানাতে গিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী এসএম আল নোমান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের খুব কাছেই সীতাকুণ্ডের অবস্থান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক তথা দেশের অর্থনৈতিক লাইফলাইনের সুবিধা। এসব সুবিধার কারণে সীতাকুণ্ডে দেশের বড় শিল্পগ্রুপগুলো শিল্পকারখানা স্থাপন করেছে। এতে স্থানীয় মানুষের কর্মের ব্যবস্থাও হয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি সীতাকুণ্ডে শিক্ষারও প্রসার ঘটেছে।

স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ

তবে নানা সুবিধার কারণে শিল্পের প্রসার ঘটলেও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন আবার সীতাকুণ্ডের বাসিন্দাদের জীবনযাপনকে মারাত্মক সমস্যায় ফেলেছে- এটাও বাস্তবতা। যেমন গত শনিবার সকালে তুলা কারখানায় আগুন লাগার পর তা নেভাতে ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর সময় লাগে প্রায় ২১ ঘণ্টা। আগুন নেভাতে গিয়ে স্থানীয় পুকুর, ছড়া ও খালের পানি শেষ হয়ে যায়। তখন কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে স্থানীয় বাসিন্দা মো. কামাল হোসেন বললেন, ‘পুকুর ভরাই ভরাই ডিপো বানাইছে। এখন আগুন লাগলে পানি পায় না। পুকুর ভরানোর সময় এসব খেয়াল থাকে না!’

দফায় দফায় সীতাকুণ্ড সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে এখানে। এর কুফল হিসেবে এখানে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, পানি সংকট, দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে চর্মসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কারখানাগুলো একাধিক ছড়া-খালে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট করেছে। আবার পুকুর ভরাট করে কারখানা-গুদাম স্থাপন করায় আগুন লাগলে অগ্নিনির্বাপণে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন : বারবার বিস্ফোরণ, উদ্বিগ্ন সরকার

সীতাকুণ্ড নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত শিল্পকারখানা এখন স্থানীয়দের গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। সরকারি নিয়ম না মেনে কারখানা স্থাপনের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডসহ নানা দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কলকারখানার পাশে বসবাস করা মানুষ হারাচ্ছে শ্রবণশক্তি। সীতাকুণ্ডে দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট। বায়ুদূষণে বাসিন্দারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, কমছে গড় আয়ু। কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য পানিতে মিশে নষ্ট হচ্ছে ভারসাম্য। আমরা শিল্পায়নের বিপক্ষে নই, কিন্তু সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিকল্পিত শিল্পায়ন চাই। অব্যবস্থাপনার মধ্যে পরিচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃঙ্খলায় আনা না গেলে সীতাকুণ্ড মৃত্যুকূপ হয়েই থাকবে।

কারখানা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই

সীতাকুণ্ডে কতগুলো শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, তা জানার জন্য অনুসন্ধানে নেমে দেখা গেছে, সরকারি দপ্তরগুলোতে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। গত বছরের জুন মাসে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে ৫১ জনের মৃত্যুর পরও এ বিষয়ে টনক নড়েনি সরকারি দপ্তরগুলোর। ফলে ওই ঘটনার আট মাসের মাথায় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে সাতজনের মৃত্যুর পরও শিল্পকারখানার প্রকৃত সংখ্যা জানাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর।

প্রসঙ্গত, বলা যায় গত ৬ মার্চ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভার কথা। সেদিন ‘চট্টগ্রাম জেলার ভারী ও মাঝারি শিল্পপ্রবণ এলাকার দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক সভা হয়। এ সভায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাতকে প্রশ্ন করেন, ‘সীতাকুণ্ডে কলকারখানা কয়টি?’

জবাবে আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত বলেন, সীতাকুণ্ডে ৫৭৫টি কারখানার নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। তবে অনেক কারখানা চালু হয়নি। আবার নিবন্ধের বাইরেও আছে কিছু। তাই সঠিক সংখ্যা জানা নেই। সেই সভায় তিনি পুরো চট্টগ্রাম জেলার কলকারখানা সম্পর্কিত তথ্য দিতে গিয়ে বলেন, নিবন্ধিত কলকারখানা ৪ হাজার ৯৪৮টি। চালু আছে ২ হাজার ৩২টি।

কলকারখানা স্থাপনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেকও সীতাকুণ্ডের কলকারখানার সংখ্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। তবে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন জানিয়েছেন, উপজেলা প্রশাসনের জরিপ অনুযায়ী এখানে ১৭৯টি শিপইয়ার্ড ও ৪৮০টি ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে।

সীতাকুণ্ডে কতটি শিল্পকারখানা আছে, সে সম্পর্কিত তথ্যের জন্য গত ৭ ও ১২ মার্চ যোগাযোগ করা হয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে। এ সময় সরেজমিন দেখা যায়, উপমহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাতের কার্যালয় বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। প্রতিষ্ঠানটির শ্রম পরিদর্শক (স্বাস্থ্য) শুভংকর দত্ত বলেন, সীতাকুণ্ডে কয়টি শিল্পকারখানা আছে, সে তালিকা এ মুহূর্তে নাই।

পরিবেশ দূষণের মূল কারণ শিল্প

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ভারী ও মাঝারি শিল্পকারখানার কারণে সীতাকুণ্ডের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। কারখানাগুলো সরাসরি মাটি, শব্দ ও বায়ু দূষণ করছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, এখানকার মোট বায়ুদূষণের ৫০ শতাংশেরও বেশি, নদীদূষণের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং শব্দদূষণের প্রায় ৩০ শতাংশ শিল্পকারখানা থেকে সৃষ্ট।

জাহাজকাটা শিল্পে পরিবেশদূষণের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একজন নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিপজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজ ভাঙা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১১’-এর ১৯ (১) বিধি অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। পরিত্যক্ত জাহাজের রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া এবং বর্জ্য, বিশেষত অ্যাসবেস্টস, গ্লাসহোল, লুব্রিক্যান্ট অয়েলসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত বিবরণ ছাড়পত্রের আবেদনে উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে সরেজমিন পরিদর্শন বা এসব যাচাই করা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শকদের জন্য কঠিন। এ কারণে অনেক পরিদর্শক এসব না দেখেই প্রতিবেদন দেন। কৌশলে এ সুযোগই কাজে লাগান ইয়ার্ডমালিকরা। জাহাজের ক্ষতিকর উপাদান আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে শ্রমিকসহ স্থানীয়রা রোগাক্রান্ত হন।

পানির রঙ অস্বাভাবিক

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিএম গেট এলাকার সিরিঙ্গে খাল, ভাটিয়ারীর ধামের খাল, কুমিরা খাল, জোড়ামতল এলাকার মানপুরা খাল, মদলহাট এলাকার মুরগুন্ধে খালসহ সব খালের পানির স্বাভাবিক রঙ বদলে গেছে। খালগুলোর পানির রঙ হলুদ, কালচে কিংবা গাঢ় নীল হয়ে আছে। এসব খাল-ছড়ার তীরেই বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য খাল-ছড়া হয়ে মিশে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের পানিতে।

বায়ুদূষণ কমানোর ব্যবস্থা নেই

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি টন সিমেন্ট উৎপাদনে প্রায় ৫১ গ্রাম ধুলা তৈরি হয়। একটি সিমেন্ট কারখানা থেকে বছরে প্রায় ৫০ টন ধুলা বাতাসে ছড়ায়। তাই বায়ুদূষণ কমাতে নির্দিষ্ট সময় পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু সীতাকুণ্ডের কারখানাগুলোতে এমন ব্যবস্থা নেই। দেখা গেছে, এখানকার সিমেন্ট কারখানাগুলোর ক্লিংকার খালাস প্রক্রিয়া চলছে উন্মুক্তভাবে। এতে প্রচুর ক্লিংকারকণা বাতাসে মিশে যাচ্ছে।

এসব কারণে দেশের অতিরিক্ত বায়ুদূষণের জেলাগুলোর তালিকায় চট্টগ্রামের নামও যুক্ত হয়েছে। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও গবেষক দলের প্রধান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২০২১ সালে পরিচালিত সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, চট্টগ্রামে বায়ুমান ১৬৫ দশমিক ৩১ মাইক্রোগ্রাম। অথচ আদর্শ বায়ুমান ৬৫ মাইক্রোগ্রাম।

সীতাকুণ্ডের বায়ু ও শব্দ দূষণের মাত্রা আলাদা করে পরিমাপ করা হয় কি না জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের উপপরিচালক মো. কামরুল হাসান জানান, সীতাকুণ্ড থেকে আলাদাভাবে শব্দ ও বায়ু দূষণের মাত্রা নেওয়া হয় না।

নিচে নামছে পানির স্তর

পানি সংকটের কথা জানিয়ে কুমিরা ইউনিয়নের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, আগে টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করতাম। তারপর পানি না পেয়ে খাল-ছড়ার পানি ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন ছড়া থেকেও পানি পাচ্ছি না। তাই চরম দুর্ভোগে আছি। ভাটিয়ারী ইউনিয়নের কদম রসুল এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়মাঠে দুটি নলকূপ রয়েছে। কিন্তু একটি থেকেও পানি পাওয়া যায় না। ফলে শিক্ষার্থীরাও রয়েছে পানির সংকটে।

পানির স্তর নিচে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সীতাকুণ্ড উপজেলার জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, পাঁচ বছরে পানির স্তর ১০ ফুট নিচে নেমেছে। তবে গ্রীষ্মকালে সারা দেশেই কিছুটা নিচে নামে। তাই বলা যায়, প্রতিবছর গড়ে এক ফুট করে নিচে নামছে পানির স্তর। ভারী শিল্পকারখানা ভূগর্ভের পানি টেনে নিচ্ছে। আবার ছড়া-খাল থেকেও নিচ্ছে। এর প্রভাব তো আছেই।

সরকারি নির্দেশনা মানছে না কারখানাগুলো

সীতাকুণ্ডের কারখানাগুলো সরকারি সব নির্দেশনা মানছে না, জানালেন উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আল মামুন। তিনি বলেন, কারখানা স্থাপন করতে সরকারি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের সনদ লাগে। কিন্তু এখন শুধু ফি দিয়ে এবং আন্ডার টেবিল টাকা দিয়ে সনদ পেয়ে যাচ্ছেন কারখানামালিকেরা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো নজরদারি করলে অগ্নিবিস্ফোরণের ঘটনা ঘটত না। বাড়বকুণ্ডে সাগরপাড়ে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে এলপিজি প্ল্যান্ট হয়েছে। অথচ সেখানে ফায়ার স্টেশন নেই। মহাসড়কের পাশে রাতদিন জমি ভরাট হচ্ছে। কারখানা হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সীতাকুণ্ডে অনেক বড় কারখানা আছে। সেগুলোর মালিকরা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এইচআর বিভাগে বসায়। তারা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দেয় না। আবার উপজেলা প্রশাসনকে কারখানায়ও ঢুকতে দেয় না।

আরও পড়ুন :  সীমা অক্সিজেনে বিস্ফোরণ : অনভিজ্ঞ লোকবল দিয়ে চলছিল উৎপাদন

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে শ্রমিক সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের চট্টগ্রামের সভাপতি তপন দত্ত বলেন, মালিক ও সরকারি তদারকি পক্ষ- দুদিকেই সমস্যা আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু চিঠি দিয়ে দায় সারছে। আর মালিকরা জরিমানাকে তোয়াক্কা করছে না। ফলে সমস্যার সমাধানও আসছে না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রাণ যাচ্ছে শুধু শ্রমিকদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের চারটি শিল্পনগরী বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহানগরীতে অবস্থিত নাসিরাবাদ, মোহরা ও কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে তদারকি করে, সীতাকুণ্ডের পরিস্থিতি তার ঠিক উল্টো। এখানে প্রশাসনিক নজরদারি কম। পাহাড়ের পাদদেশে শিল্পকারখানা স্থাপনে প্রাকৃতিক ভারসাম্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ধারাবাহিক দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদহানির ঘটনা বাড়ছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা