বেআইনিভাবে অকৃতকার্য
সিরাজগঞ্জ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৩ ১৮:৩৫ পিএম
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৩ ১৮:৪৬ পিএম
জিল হোসেন । ছবি : প্রবা
ভগ্নাংশেরও কম নম্বরের জন্য পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার ৫০ বছর পর হাইকোর্টে ন্যায়বিচার পেয়েছেন জিল হোসেন নামের প্রয়াত এক ব্যক্তি। মঙ্গলবার ( ৭ মার্চ ) দুপুরে বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে এ রায় দেন।
ফলে ২০০৮ সালে দেওয়া রায় অনুযায়ী দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে জিল হোসেনের পরিবার। সেই সঙ্গে ২০০৮ সাল থেকে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান জিল হোসেন।
আদালত জিল হোসেনের রায় প্রকাশের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লুকোচুরি করেছে উল্লেখ করে বলেন, এই আচরণের কারণে জিল হোসেনের জীবন ধ্বংস হয়েছে।
১৯৭৩ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দশমিক পাঁচ নম্বরের জন্য জিল হোসেনকে বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে আবারও পরীক্ষায় বসলে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
আদালতে মামলা করলে দীর্ঘ ২২ বছর পর এবং হাইকোর্টের রায়ের ১৪ বছর পর ১৯৯৭ সালে ৪৭ বছর বয়সে সনদ হাতে পান তিনি। এরপর ২০০০ সালে ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন জিল হোসেন।
জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালে সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে। আদালতের রায়ের পর ৪৭ বছর বয়সে তার হাতে পরীক্ষা পাসের সনদ আসে। যা কোনো কাজে আসেনি।
আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আইনজীবী তানিয়া আমীর ও মিয়া মো. ইশতিয়াক শুনানিতে ছিলেন। প্রয়াত জিল হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস।
রায়ের পর চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, ’হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই কোটি টাকা দাবি করে মামলা করা হয়। এ মামলায় বিচারিক আদালত ২০০৮ সালে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দেন। ওইদিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে আরও ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হবে। মোট টাকা থেকে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদালতে জমা করা ২৫ লাখ টাকা বাদ যাবে। প্রয়াত জিল হোসেনের স্ত্রী ও আট সন্তান ওই অর্থ পাবেন।
মামলা থেকে জানা যায়, ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফলাফলে জিল হোসেনকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করে বিফল হন তিনি। পরে ১৯৭৫ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাকে বহিষ্কার করা হয়।
এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, ১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ মামলায় আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়ে জিল হোসেনকে বহিষ্কার আদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়। একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন তার বয়স ৪৭ বছর। পরে ২০০০ সালে ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন।
জিল হোসেনের ছোট ছেলে নূর মোহাম্মদ বলেন, আমার বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল মামলার রায় দেখে যাওয়ার। আজ তিনি বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন।