প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৩ ১৯:২৫ পিএম
প্রবা ফটো
দশ বছর কেটে গেছে কত অপেক্ষায়! প্রিয় স্বজন, কত প্রিয়মুখ এখনও প্রতীক্ষায় একটি রায়ের, যে রায়ে সর্বোচ্চ সাজা পাবে মেধাবী ত্বকীর ঘাতকদল। বিচারের দাবিতে দেশের সুধীমহলের বিবৃতি, মানববন্ধন, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি-কত কিছুই না হয়েছে গত দশ বছরে। নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে উচ্চকিত হয়েছেন দেশের প্রাজ্ঞজন। তবুও অভিযোগ আসে, তার ঘাতকের দল বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ধামাচাপা পড়ে থাকে বিচারের দাবি।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ অপহরণ হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র ত্বকী। এর দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ মামলাটির তদন্ত শুরু করে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় ২৮ মে ২০১৩ উচ্চ আদালতের নির্দেশে র্যাব এর তদন্তভার গ্রহণ করে। সেই তদন্ত কার্যক্রম এখনও চলছে।
ত্বকী হত্যার দশ বছরে দেশের ৭৭ জন প্রবীণ ও নবীন শিল্পী এবার ক্যানভাসে নানা মাধ্যমে নিজেদের প্রতিবাদ চিত্রিত করেছেন। ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক, মিশ্র মাধ্যম বা পেন্সিল স্কেচে ত্বকীর প্রতিকৃতি এঁকে কিংবা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের আঁকা সেই সব চিত্রকর্ম নিয়ে চিত্রপটে ত্বকী পর্ষদের আয়োজনে গতকাল সোমবার থেকে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা লবিতে শুরু হয়েছে সাতদিনব্যাপী চিত্রকর্ম প্রদর্শনী।
সোমবার (৬ মার্চ) সকালে শুরু হওয়া সেই প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। জাতীয় জাদুঘরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখা শেষে তারা আসেন বঙ্গমাতা লবিতে। উৎসুক শিক্ষার্থীরা নানা প্রশ্নে জানতে চান ত্বকীর কথা। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে শিউরে উঠেন এক মধ্যবয়সী নারী। তিনি বলে উঠেন, ‘এইটুকুন ছেলেকেও ওরা ছাড়েনি।’ এক তরুণী দর্শক পেন্সিলে আঁকা তরুণ ত্বকীর চিত্রকর্মের সামনে অশ্রুসজল হয়ে উঠেন।
প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান, রফিকুন নবী, নিসার হোসেন, মনিরুজ্জামান, আবদুস শাকুর, বীরেন সোম, শিশির ভট্টাচার্যদের আঁকা নানা চিত্রকর্ম। রফিকুন নবীর অ্যাক্রেলিকে আঁকা ছবিতে দেখা যায়, এক সবুজ দরোজার ওপাড়ে চৌহদ্দিতে বসে আনমনে খেলছে এক শিশু। কোথা থেকে ওড়ে আসে এক কালো কাক, যেন তার সব খেলা পণ্ড করতে চায়! হাশেম খানের চিত্রকর্মে দেখা যায়, শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা উড়ে যাচ্ছে গোলার্ধ্বের বাইরে, যেন তার সব প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
ত্বকীর মৃতদেহ মিলেছিল শীতলক্ষ্যা পাড়ে। প্রিয় নদী এখনও যেন বহু শিল্পীর চোখে এক রক্তগঙ্গা। সেই রক্তগঙ্গাকে উপজীব্য করে শিল্পীদের কেউ ভেসেছেন শোকসায়রে, কেউ এঁকেছেন সম্মেলক প্রতিবাদের কথা। ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে শিল্পী নিসার হোসেন মিশ্র মাধ্যমে এঁকেছেন ‘বাগানে ঘাতক’।
দুলাল চন্দ্র গাইনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে মার্চের সেই কালোরাত। বস্তাবন্দি অবস্থায় শীতলক্ষ্যাপাড়ে পড়ে আছে ত্বকীর রক্তাক্ত মৃতদেহ। রণজিৎ দাসের অ্যাক্রেলিকে আঁকা চিত্রপটে সেই রক্তগঙ্গা উঠে আসে মুষ্টিবদ্ধ তিনটি হাত। অন্ধকারের গর্ভগৃহ থেকে উঠে আসা তিনটি হাতে কারা যেন সব আলো ঠিকরে দেয়। সেই তিনটি হাত হয়ে উঠে প্রতিবাদের বিমূর্ত প্রতীক। সুমন ওয়াহিদ ছবির শিরোনাম ‘একটি বিচারের অপেক্ষায়।’ অ্যাক্রেলিকের ক্যানভাসে একটি কবিতাও সেঁটে দেন শিল্পী। কবি বলে যান- ‘যুদ্ধের সেই সব নায়কেরা ডাক দিয়ে যায় জাতির জন্য/জেগে উঠার জন্য।’ রুবিনা নার্গিস ও সনজীব দাস অপুর ক্যানভাসে ত্বকী পুনর্জীবিত হয়ে উঠেন প্রতিবাদের অগ্রসেনানী হিসেবে। ‘ছিন্ন কর বন্ধনের এ অন্ধকার’ এ শিল্পী নার্গিস আহ্বান জানান সম্মিলিত প্রতিবাদের। সনজীবের রংতুলিতে ত্বকী হয়ে উঠেন একালের ‘অভিমন্যু’। ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বির আঁকা একটি ছবিও ঠাঁই পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। ছেলে হত্যা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় বাবার দীর্ঘ লড়াই আর আক্ষেপের কথা যেন ফুটে উঠে ‘ক্রুশের গল্প’ শিরোনামের ওই ছবিতে।
প্রবীণ শিল্পীদের আঁকা এই চিত্রকর্মের পাশে লবির এক কোণে ৩৩ জন নবীন শিল্পীর আঁকা ৩৩টি প্রতিকৃতি ঠাঁই পেয়েছে। সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ১১ মার্চ পর্যন্ত।