× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বছর না ঘুরতেই সীতাকুণ্ডে আরেক ট্র্যাজেডি

এস এম রানা, হুমায়ুন মাসুদ ও আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩ ২৩:০৬ পিএম

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩ ২৩:১০ পিএম

বিস্ফোরণের পর শনিবার সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট ঘুরে দেখেন উদ্ধারকারীর দলের সদস্য ও স্থানীয়রা। ফোকাস বাংলা

বিস্ফোরণের পর শনিবার সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট ঘুরে দেখেন উদ্ধারকারীর দলের সদস্য ও স্থানীয়রা। ফোকাস বাংলা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে গত বছরের ৪ জুন বিস্ফোরণে ৫১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন দুই শতাধিক মানুষ। এবার বছর না পেরোতেই আরেক ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হলো সীতাকুণ্ড। শনিবার (৪ মার্চ) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড নামের কারখানায় বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন ছয়জন। আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। অক্সিজেন কারখানাটি বিএম ডিপো থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

নিহতদের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তারা হলেন সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল গ্রামের শামসুল আলম (৬৫), একই উপজেলার ভাটিয়ারী জাফরাবাদ মধ্যম সলিমপুর এলাকার ফরিদ আহমদ (৩৬), নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার ছোট মনগড়া গ্রামের রতন লক্রেট (৪৫), নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানার আব্দুল কাদের ও লক্ষ্মীপুরের মো. সালাউদ্দিন। অন্যজনের পরিচয় রাত ১০টা পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি প্রশাসন।

আহতদের মধ্যে ১৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন মো. ফোরকান (৩৩), মো. নূর হোসেন (৩০), মো. আরাফাত (২২), মোতালেব (৫২), মাকসুদুল আলম (৬০), মো. ওসমান (৪৫), মো. সোলাইমান (৪০), মো. রিপন (৪০), মো. আজাদ (২২), রিপন মারুফ (৬০), প্রশেকা (৪০), নারায়ণ ধর (৪৪), মো. জসিম (৫০), ফেন্সি (২৬), মো. জাহেদ (৩০), মো. মজিবুল হক (৪৫), রোজি বেগম (২০) ও ফাহিম শাহরিয়ার (২৬)। 

সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের মালিকপক্ষের তিন ভাইয়ের নাম মামুন উদ্দিন, আফতাব উদ্দিন ও পারভেজ উদ্দিন। তাদের সীমা স্টিল নামে শিপইয়ার্ড কারখানা রয়েছে।

যথারীতি উদ্ধার কাজের সময় অক্সিজেন কারখানার মালিকপক্ষের কারও দেখা পায়নি প্রশাসন। রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় সেনাবাহিনীর সদস্য, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা অন্ধকারে লাশ হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন। অন্ধকারে লাশ বা আহত কর্মীদের খোঁজার সময় ওই কারখানার কোথায় কী আছে, না ছিল-সেই বিষয়েও উদ্ধারকারীরা কারও কাছে কোনো তথ্য পাচ্ছিলেন না।

বিস্ফোরণের পরপরই ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়রা ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। আহতদের মধ্যে রাত ৮টা পর্যন্ত ২১ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

বিস্ফোরণের শব্দে আশপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা কেঁপে উঠে। প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে একটি দোকানে বসে সংবাদপত্র পড়ার সময় বিস্ফোরিত সিলিন্ডারের অংশের আঘাতে মারা যান শামসুল আলম। বিস্ফোরণে আশপাশের এলাকার ঘরের দরজা-জানালা ভেঙেছে। অনেক বাড়ি তছনছ হয়েছে। টিনের তৈরি অনেক ঘর দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। বিস্ফোরণের পরপরই যারা উদ্ধারকাজে গেছেন, তাদের চোখে জ্বালাতন দেখা দেয়। ফলে নাকেচোখে পানি ছিটিয়েও উদ্ধারস্থলে কার্যক্রম চালাতে সমস্যা তৈরি হয়। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে সেখানে ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। 

রাত সাড়ে ৮টায় উদ্ধার কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, ‘আজকের মতো উদ্ধার কার্যক্রম শেষ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে রাতে অবস্থান করবেন। সকালে পুনরায় উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রথমে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। পরে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হতে পারে।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন স্থানীয় গাউসিয়া কমিটির টিম লিডার নুর উদ্দিন বলেন, বিস্ফোরণের সময় আমি কারখানা থেকে কিছুটা দক্ষিণে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে আঁতকে উঠি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি, বড় ধরনের বিস্ফোরণে কানে শব্দ কম শুনতে পাচ্ছি। এরপর বিস্ফোরণস্থলের দিকে ছুটে গিয়ে দেখি, সবই লণ্ডভণ্ড। পরমুহূর্তেই উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করি।

দুর্ঘটনার পর সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। এ সময় তিনি বলেন, বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাকিব হাসানকে।

বিস্ফোরণের পর আশপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রবা ফটো

এরপর ঘটনাস্থলে পৌঁছান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি উদ্ধার তৎপরতা তদারকি করেন। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স সেখানে নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছিলেন। আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছিলেন উদ্ধার কাজে। পাশাপাশি বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার সময়ের মতো স্থানীয় গাউছিয়া কমিটির সদস্যদের দেখা গেল উদ্ধার তৎপরতায় ব্যস্ত সময় পার করতে।

ফায়ার সার্ভিস, গাউসিয়া কমিটি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্ধার তৎপরতার সময় দেখা গেছে, বিধ্বস্ত কারখানার আশপাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ধসে যাওয়া নানা সরঞ্জাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আশপাশে কয়েকটি ট্রাক দেখা গেল ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায়। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেনাবাহিনীর একটি দল। ২৪ মিলিটারি পুলিশ ইউনিটের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহমুদুজ্জামানের নেতৃত্বে উদ্ধারকারী দলে মেডিকেল সেবা দেওয়ার জন্য একটি টিমও ছিল।

অগ্নি নির্বাপণে যুক্ত থাকা কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলেন, বিস্ফোরণ কীভাবে হয়েছে তা তদন্তের আগে বলা যাচ্ছে না। এখন উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত আছি।

একই বিষয়ে সীতাকুণ্ড থানার অফিসার ইনচার্জ তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পুলিশ উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করছে। এখান থেকে হতাহতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

হতাহতদের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয় জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২১ জন। অনেকের হাতে পায়ে ফ্র‌্যাকচার আছে। সবাইকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। আহতদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা দুইজন মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। আমাদের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

শনিবার সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ জণাকীর্ণ এলাকায় পরিণত হয়। একের পর এক গাড়িতে করে আহত রোগীদের আনা হচ্ছিল হাসপাতালে। সেখানে স্বজনদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করে নিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একটি টিম হাজির হয়। রেডক্রিসেন্ট, গাউছিয়া কমিটি, বেওয়ারিশ ফাউন্ডেশনসহ একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরাও পৌঁছেন হাসপাতালে। দ্রুত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাৎক্ষণিকভাবে ডেস্ক স্থাপন করে রোগীদের জরুরি ঔষধ সরবরাহ করা শুরু হয়। এ সময় সাধারণ অনেক মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ জরুরি বিভাগের সামনে রক্ত লাগবে কি না জানতে চেয়ে হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। জরুরি বিভাগের গেট জনাকীর্ণ হয়ে পড়ায় পুলিশকে ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। ওষুধ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে অনেকেই পুলিশকে অনুরোধ করেন, তাদের যেন ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তবে নিরাপত্তা ও চিকিৎসা সেবা নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে পুলিশ কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।

কারখানাতে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কি না সেই বিষয়ে প্রশাসন এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলেনি। বিএম ডিপো বিস্ফোরণের পর গঠিত তদন্ত কমিটিতে উঠে আসে, ডিপোর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল না। এছাড়া ডিপো কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম রাখেনি। বিএম ডিপোর মতো চট্টগ্রামের অন্য কারখানাগুলোতেও নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকার বিষয় উঠে এসেছিল।

এর বছর না ঘুরতেই অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটল। স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ওই কারখানায় প্রায় দুই শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন। গতকাল শ্রমিক কম ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কত শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন সেই তথ্য মালিকপক্ষের কারও মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে ফোন করে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী জানান, ওই কারখানায় অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম যথাযথভাবে ছিল না। অন্য মালিকদের মতো সীমা অক্সিজেন কারখানার মালিকও এই বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। ফলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা