× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হাওরে হুমকির মুখে প্রাথমিক শিক্ষা

সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল

প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫৩ পিএম

নানা সসীমাবদ্ধতার মধ্যে পানির সঙ্গেও লড়তে হয় কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের। বাজিতপুরের মাইজর ইউনিয়নেপানির মধ্যে গড়ে তোলা স্কুলে নৌকায় করে যেতে হয় শিশুদের। সম্প্রতি তোলা-প্রবা ফটো

নানা সসীমাবদ্ধতার মধ্যে পানির সঙ্গেও লড়তে হয় কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের। বাজিতপুরের মাইজর ইউনিয়নেপানির মধ্যে গড়ে তোলা স্কুলে নৌকায় করে যেতে হয় শিশুদের। সম্প্রতি তোলা-প্রবা ফটো

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে হুমকির মুখে পড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রতি বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে গড়ে ৩০০ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকটে শিক্ষকরা অলস সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির পর থেকে অনেক শিশু আর বিদ্যালয়মুখী হয়নি। অনেক মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে। তা ছাড়া বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক সংকটও প্রবল। পুরো হাওরাঞ্চলে ২২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৬টিতে নেই প্রধান শিক্ষক।

সম্প্রতি সরেজমিন কয়েকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সামান্য কিছু শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে পাঠ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি এত কম কেন- এমন প্রশ্নে বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক জানান, ২০২০ সালে মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের পাঠানো বন্ধ করে দেন। তা ছাড়া সে সময় সরকারি সিদ্ধান্তে স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় পরে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়বিমুখ হয়ে যায়। তার ওপর হাওরাঞ্চলে দুই দফা ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। অনেক বিদ্যালয় পানির নিচে তলিয়ে যায় এবং অনেক বিদ্যালয়ে আসার রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এসব কারণেও হাওরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে আসে। বিশেষ করে করোনাকালে অনেক অভিভাবক মেয়ে শিক্ষার্থীদের বাল্যবিবাহ দিয়ে দেওয়ায় তারা আর বিদ্যালয়মুখী হয়নি।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের হাওরের চারটি উপজেলায় মোট ২৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে অষ্টগ্রামে ৮৩, ইটনায় ৭২, মিঠামইনে ৭৫ ও নিকলীতে ৬৯টি। এসব বিদ্যালয়ে মোট ছাত্রছাত্রী ৭২ হাজার ৮০০। এর মধ্যে ইটনা উপজেলায় ২১ হাজার ৪৫৮, অষ্টগ্রামে ২৩ হাজার ৪৫৮, মিঠামইনে ১৬ হাজার ৯৫৪ ও নিকলীতে ১১ হাজার ২২ জন। সাম্প্রতিক সময়ে ৪ হাজার ৩৬৪ বা ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

তবে এ পরিসংখ্যান সঠিক নয় জানিয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) শিক্ষা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. আবদুল গণি বলেন, কিশোরগঞ্জের হাওরে সামপ্রতিক দুই দফা বন্যা, কোভিড মহামারির কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী ১০ হাজার অতিক্রম করেছে। কারণ জীবন-জীবিকার তাগিদে হাওর থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক বড় বড় শহরে সন্তানদের নিয়ে চলে গেছেন।

একই কথা বলেছেন, মিঠামইন উপজেলার সংস্কৃতিকর্মী রতন কর। তিনি জানান, তার প্রতিবেশী স্বপন সূত্রধর স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রাম চলে গেছেন। হাওরে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এসব হিসাবে আনলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় গত তিন বছরে অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী পাঠদানের বাইরে রয়েছে।

মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আবুল কাসেম বলেন, হাওরে কোভিডসহ নানান কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। বিশেষ করে গত বছরের দুই দফা বন্যায় বাড়িঘর হারিয়ে এবং খাতা-বইসহ শিক্ষা উপকরণের অভাবে অনেকেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে হাওরে প্রাথমিক শিক্ষা অনেকটাই গতিহীন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের সংকটের কারণে হাওরে শিশু শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে দেখভাল করা যায়নি বলে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহী হয়ে উঠতে পারছেন না। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতার কারণে জীবন যখন সংকটে পড়ে তখন হাওরের শিশুটিকেও কাজে লাগাতে চান বাবা-মা। ফলে শিক্ষার বদলে কম বয়সেই তাদের কিছু না কিছু কাজ করতে হয়। কোনো কাজ না পেলে বাবা-মাকে সাহায্য করা তাদের কাজের মধ্যে পড়ে। আর্থিক অনটন, কুসংস্কার তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে অভিভাবকরা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না।

কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান বলেন, হাওরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবার একটু বেশি হবে। এটাই হাওরের স্বাভাবিক চিত্র। দুই দফা বন্যায় ফসল হারানো কৃষক-শ্রমিক হাওর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তা ছাড়া আধুনিক যান্ত্রিকতার কারণে হাওরে অনেকের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জেলে সম্প্রদায় আগের মতো মাছ শিকার করতে পারছে না। মৃৎশিল্পীরাও তাদের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব সম্প্রদায়ের লোকজনের একটি বড় অংশ হাওর ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। ফলে হাওরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে এটাই হলো হাওরের বাস্তবতা।

মিঠামইন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘কোভিড মহামারি ও বন্যার কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমে গেছে। কিন্তু বছরের শুরুতে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের সবাই অভিভাবকদের শরণাপন্ন হয়েছি। অনুরোধ করেছি বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে। ফলে দিন দিন শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা এলাকা ছেড়ে চলে গেছে তাদের তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এর পরও যেসব শিশু স্কুলে যেত না তাদের স্কুলে আনার জন্য অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। আশা করি প্রধান শিক্ষক সংকট দূর করে এ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক বলেন, ‘ঝরে পড়া শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা এ মুহূর্তে সঠিক কত তা বলা কঠিন। তবে হাওরে ঝড়ে পড়া শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের একটি সংখ্যা মাইগ্রেট। এ ব্যাপারে আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। হাওরের সব উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। আশা করি ঝরে পড়া শিক্ষার্থী কমে আসবে।’

এদিকে হাওরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় যেমন শিক্ষক সংকট রয়েছে, অনেক বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষকও। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২৯৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৬টিতে প্রধান শিক্ষক নেই। অষ্টগ্রামে ৮৩টি পদের বিপরীতে প্রধান শিক্ষক আছেন ১৯ জন, ইটনায় ৭২ জনের মধ্যে আছেন ৩০ জন, মিঠামইনে ৭৫ জনের মধ্যে আছে ৩১ জন। নিকলীতে ৬৯ জনের মধ্যে ২২টি পদে প্রধান শিক্ষক নেই। ফলে চারটি হাওর উপজেলায় ২৯৯ প্রধান শিক্ষকের বিপরীতে রয়েছের মাত্র ২০৩ জন। এসব বিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে। স্থায়ীভাবে প্রধান শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয়গুলোয় প্রশাসনিক দুর্বলতাসহ নানান সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

একাধিক সহকারী শিক্ষক জানান, প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দাপ্তরিক ও সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলা শহর ও উপজেলা সদরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকরা এসব কাজ করতে গেলে সহকারী শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে পারেন না। এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক জানান, নতুন নিয়োগে শতাধিক প্রধান শিক্ষকের পদ পূরণ হবে। অন্য শূন্যপদেও শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা