দিনাজপুর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:০৯ পিএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৫০ পিএম
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল নিজেই যেন রয়েছে মুমূর্ষু অবস্থায়। একদিকে চিকিৎসক সংকট, অন্যদিকে নানা অনিয়ম ও দালালের দৌরাত্ম্য! ফলে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।
হাসপাতালটিতে মোট ৬০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছেন ২৪ জন। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি পদ শূন্য।
কার্ডিওলজি, শিশু, রেডিওলজি, প্যাথলজি, অর্থসার্জারি, চক্ষু, মেডিসিন, ওরাল সার্জারি, মেডিকেল অফিসার, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, হৃদরোগ, চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ এবং নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পদগুলো শূন্য রয়েছে। এতে বিশেষ করে বিপাকে পড়েছে গরিব ও অসহায় রোগীরা। হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সার্জারি বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় ২৬ বেডের নারী এবং ৫৯ বেডের পুরুষ ওয়ার্ডের অধিকাংশ বিছানা খালি পড়ে আছে।
দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ অনেক পুরোনো। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নার্সদের অসদাচরণ। বোচাগঞ্জ উপজেলার মাহেরপুর থেকে আসা মোকলেসুর রহমান জানান, তার স্ত্রীর ডেলিভারি বাবদ যাবতীয় ওষুধ তাকে বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালটি থেকে কোনো ওষুধ পাননি তিনি।
বিরল উপজেলার পলাশবাড়ী থেকে এসেছিলেন আজাহার আলী নামের এক রোগী। তিনি জানালেন, শরীরে পুশ করা সুই, স্যালাইন, ওষুধ কিছুই হাসপাতাল থেকে পাননি, সব বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।
খানসামা উপজেলার কাচিনিয়া থেকে আসা ফারুক হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালে হার্নিয়া অপারেশন করতে এসেছিলাম। কিন্তু ঢুকেই শুনি এখানে কোনো চিকিৎসক নেই। ফলে বাধ্য হয়ে বাইরে অপারেশন করাতে হচ্ছে। হাসপাতালের একজনের মাধ্যমে একটি ক্লিনিকে যাচ্ছি।’
প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর দাপটে সরকারি হাসপাতালে গিয়েও অসহায় অবস্থা রোগীদের। সেখানে চিকিৎসা না দিয়ে পছন্দের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিকে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের। দালালরা ছাড়াও কিছু নার্স ও চিকিৎকের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে। আর তাদের পছন্দের ক্লিনিকগুলোতে গিয়ে এক প্রকার সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে গরিব রোগীদের।
সদর উপজেলার নয়নপুর থেকে দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে এসেছেন অন্তঃসত্ত্বা মর্জিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘কম খরচে চিকিৎসার জন্য এখানে এসেছি। কিন্তু এসে দেখি চিকিৎসক নেই। তাই বাইরে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালাম।’
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. ফজলুর রহমান বলেন, এখানে মোট ৬০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও সেখানে আছে ২৪ জন। ৩৬ জনের পদই শূন্য। ফলে একসময় প্রতিদিন যেখানে ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী ভর্তি থাকত, সেখানে এখন ২০০ রোগীও ভর্তি থাকছে না।
আগে প্রতিমাসে হাসপাতালটিতে মেজর ও মাইনর মিলিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ রোগীর অপারেশন হতো। সেখানে ২০২২ সালের নভেম্বরে ৬৮ জন এবং ডিসেম্বরে ৬৫ জনের মেজর অপারেশন হয়েছে। গত জানুয়ারিতে মেজর অপারেশন ছিল ১০১টি আর মাইনর অপারেশন ছিল ১৯৮টি।
মেজর অপারেশনের মধ্যে হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, গোলব্লাডার, লিভার কিডনি, পাইলস ইত্যাদি অপারেশন করা হতো। চিকিৎসক না থাকার কারণে এসব অপারেশন প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, ‘এখানে হৃদরোগ, চর্ম ও যৌন, নাক-কান-গলার চিকিৎসক নেই। ফলে সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার যেই অপারেশন হাসপাতালে ফ্রি করানো হয়, সেটা বাইরে করতে গেলে ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ পড়ে। এতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।’
তিনি বলেন, সার্জারি বিভাগে মেজর ও মাইনর উভয় ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় অপারেশন প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।
শুধু চিকিৎসক সংকটই নয়, হাসপাতালটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে। আবার জনবলের অভাবে অনেক মেশিন বিকল হয়ে আছে। এ ছাড়া হাসপাতালের নোংরা টয়লেটের দুর্গন্ধে রোগীর সুস্থ স্বজনদেরও অসুস্থ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়।