কুষ্টিয়া প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:০৪ পিএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:০৬ পিএম
রাইস মিলের ছাই দিয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল গ্রামের কৃষক দিদার হোসেন ঘাস লাগানোর জন্য শ্যালোমেশিন দিয়ে জমিতে পানি দিচ্ছেন। প্রবা ফটো
দখল আর দূষণে বিপর্যস্ত জিকের (গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প) এস-৪ টি-১ খাল। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন তিন গ্রামের কয়েক হাজার চাষি। খালটির অবস্থান কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নের বটতৈল, কবুরহাট ও শিমুলিয়া গ্রামে।
গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের প্রধান খাল থেকে (বটতৈল গ্রাম) শুরু হয়ে কবুরহাট গ্রাম হয়ে শিমুলিয়া গ্রামে গিয়ে মিশেছে। এই সেচ খালের আওতায় প্রায় ১ হাজার ৮০০ বিঘা চাষযোগ্য জমি আছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল।
গত রবিবার সকাল ১০টার দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাবুরহাট কদমতলা এলাকায় সেচ খালের মাঝে দেড় ফুট ব্যাসের পাইপ দিয়ে খাল ভরাট করা হয়েছে।
এই খালের দখলদার ও দূষণকারীরা হলেন বাবুরহাট কদমতলা এলাকায় অবস্থিত তারা রাইস মিলের মালিক ফরিদুল ইসলাম তারা, আব্দুল্লাহ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টসের মালিক আনোয়ার হোসেন অ্যান্ড ব্রাদার্স, কাবিল এগ্রো ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেডের মালিক ইসমাইল হোসেন মুরাদ, আহাদ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টের মালিক আমিরুল ইসলাম এবং ভুসিমালের ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী।
অপরদিকে কুষ্টিয়া-পোড়াদহ সড়কের অপর পাশের জাফর ফুড প্রোডাক্টস ও এগ্রো ফুড প্রোডাক্ট থেকে সড়কের নিচ দিয়ে পাইপের মাধ্যমে এস-৪ টি-১ খালে বর্জ্য ফেলেন প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক আবু জাফর মোল্লা।
সেচ খাল ধরে কিছুদূর গিয়ে দেখা মেলে কৃষক দিদার হোসেসের (৬৩) সঙ্গে। তিনি ৫ কাঠা জমিতে ঘাস লাগানোর জন্য রাইস মিলের ছাই-বর্জ্য দিয়ে ভরাট হওয়া ক্যানেল থেকে শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে পানি দিচ্ছিলেন।
তিনি মোট ৫ বিঘা জমি আবাদ করেন জানিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই ক্যানেলের পানি দিয়ে বটতৈল, কবুরহাট ও শিমুলিয়া তিন গ্রামের আবাদ হতো। কিন্তু এখন মাজা (কোমর) সমান ছাইয়ের কারণে ক্যানেলের পানি আসে না, যদিও আসে নিকটতম জমিগুলোতে ভাইটে চলে (উপচিয়ে পড়ে) যায়, গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই মাঠে ৮-৯ বছর আগেও তিনটি ফসল হতো। এখন ক্যানেলে পানি আসে না, আমরা শ্যালো দিয়ে (সেচ) আবাদ করছি। মিলের ছাই-বর্জ্য দিয়ে ক্যানেলটি প্রায় তিন ফুট ভরাট হয়ে গেছে। পানি বেশিদূর যেতে পারে না। ক্যানেলটা তিন কিলোমিটার লম্বা। এক কিলোমিটার পানি সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, আর দুই কিলোমিটারে পানি পৌঁছায় না।’
তিনি বললেন, ‘ওই দেখুন, রাস্তার ওপাশ থেকে জাফর মিলের পানি পাইপ দিয়ে খালে আসছে।’
এরপর সেচ খাল ধরে পাঁচশ মিটার গিয়ে দেখা মেলে কবুরহাট এলাকার চাষি একুব্বার হোসেনের (৭১) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই ক্যানেলের পানি আমাদের কোনো উপকারে আসে না। পচা, দুর্গন্ধযুক্ত এই পানির সেচ দিলে ধানের গোড়া থেকে পচে যায়। ধানের ফলন ভালো হয় না, বিঘাপ্রতি ৭-৮ মণ ধান পাওয়া যায়। আমার মতো ক্ষুদ্র চাষি, যাদের ৪-৫ বিঘা জমি আছে, ডিপ টিউবওয়েলের পানি নিলে (বিঘাপ্রতি ৪ হাজার টাকা) কোনোমতেই খরচ ওঠে না। এর আগে ৪ কাঠা জমি বিক্রি করে বীজ, সার ও পানির দেনা (ঋণ) শোধ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় দশ বছর আগে বাবুল চেয়ারম্যান (সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ) এই ক্যানেলটাকে খনন করেছিল। তখন একটু পানি ছিল। গত ৭-৮ বছরে রাইস মিলের ছাই ও বর্জ্য পানির কারণে ক্যানেলের ৩-৪ ফুট ভরাট হয়ে গেছে। যেটুকু আছে তাও পচা, দুর্গন্ধযুক্ত। আমরা গরিব চাষি, টাকাওয়ালা মিলমালিকদের সঙ্গে পারি না।’
খালটি ভরাট হওয়ার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বটতৈল এলাকায় জিকের প্রধান থেকে শুরু হয়ে এস-৪ টি-১ সেচ খালটি (ক্যানেল) কবুরহাট গ্রাম হয়ে শিমুলিয়া গ্রামে গিয়েছে। এই খালের কোনো অংশ ইজারা বা ভাড়া দেওয়া হয়নি।
পাউবো কুষ্টিয়ার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবদুল হামিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাইটটি ভিজিট করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আজকেই (২৯ জানুয়ারি) নির্বাহী প্রকৌশলীকে বলব আমি।’
খাল ভরাটের অভিযোগ প্রসঙ্গে জাফর ফুড প্রোডাক্টের মালিক আবু জাফর মোল্লা বলেন, ‘রাস্তার ওপারে খালে পানি দেওয়ার ব্যাপারটা আমার জানা নেই। আমার ছোট ভাই মিল দেখাশোনা করে। ওর কাছ থেকে শুনে আপনাকে জানাতে পারব।’