× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইউরোপে যাচ্ছে সবজি, চাষির মুখে হাসি

শরীয়তপুর প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:৫৮ এএম

শরীয়তপুরের জাজিরার কৃষকদের উৎপাদিত সবজি রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপে। প্রবা ফটো

শরীয়তপুরের জাজিরার কৃষকদের উৎপাদিত সবজি রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপে। প্রবা ফটো

৪ জানুয়ারি বুধবার। রাজধানী থেকে মাত্র ৫০ মাইল দূরের জাজিরার কৃষকদের জীবনে যুক্ত হলো নতুন এক আখ্যান। ইউরোপে রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হলো তাদের উৎপাদিত সবজির। যা ছিল একসময় চিন্তার বাইরে। অথচ পদ্মা সেতু চালুর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই সেই অসাধ্য সাধন হলো; সরাসরি ইউরোপের বাজারে গিয়ে হাজির হলো শরীয়তপুরের জাজিরার সবজি। হাসি ফুটল অবহেলিত কৃষকদের মুখে। 

জাজিরার মিরাশার চাষিবাজার থেকে স্থানীয় কৃষকদের সবজি এখন সরাসরি কিনছেন রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। ফলে মধ্যস্বত্বভোগীরাও হারিয়েছে দাপট। জাজিরার সবজি দিয়ে কৃষিপণ্য রপ্তানির এ পথপরিক্রমায় সামনের দিনগুলোয় যুক্ত হবে শরীয়তপুরের আম, মাল্টা, ড্রাগনসহ নানা ফল। 

ইতোমধ্যেই জাজিরার লাউ, করলা, শিম, কচু আর কাঁচা মরিচ রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্য, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের বাজারে। নিরাপদ কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্ববাজারে। পদ্মাপারের চাষিদের বিষমুক্ত সবজির দিকে তাই চোখ পড়েছে ইউরোপিয়ানদের, চোখ পড়েছে রপ্তানিকারকদের। এ সুযোগ কাজে লাগানোর পথ প্রশস্ত হয়েছে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শরীয়তপুরে ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয় বিভিন্ন কৃষিপণ্য। যার মধ্যে পদ্মা সেতু ঘেঁষা জাজিরায় আবাদ করা হয় ১৭ হাজার ৮৭৬ হেক্টর কৃষিজমি। সেতু হওয়ার পর পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় উপজেলার অনাবাদি কৃষিজমিকেও চাষের আওতায় আনতে কাজ শুরু করেছে স্থানীয় কৃষক, প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ। 

শুরু হয়েছে সবজি রপ্তানি 

ইউরোপে সবজি রপ্তানির উদ্যোগ নেয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। গত ৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার বিকেলে জাজিরার মিরাশার চাষিবাজার থেকে সবজির প্রথম চালান যায় ঢাকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউসে। সরকারি রপ্তানি নিয়ম সম্পন্ন করে সেখান থেকে পরদিন বুধবার বিমানযোগে সুইজারল্যান্ডে পৌঁছায় বিএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এভাবেই শুরু হয় নতুন এক পথপরিক্রমা। এ পর্যন্ত জাজিরা থেকে রপ্তানি হয়েছে ৭০ কেজি কচু, ২০ কেজি লাউ ও ৪১৫ কেজি কাঁচা মরিচ।

বিএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম কল্লোল বলেন, ‘আমরা আপাতত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সবজি সুইজারল্যান্ডে পাঠাচ্ছি। আশা করছি, জাজিরায় উৎপাদিত রপ্তানির মানসম্পন্ন সব ধরনের সবজি শিগগির পুরোদমে ইউরোপে রপ্তানি শুরু করতে পারব।’

জাজিরার মুলনা এলাকার কৃষক সিরাজ মাদবর বলেন, ‘এর আগে পাইকাররা কচুর দাম ৩০-৩৫ টাকার বেশি বলত না। তাই মন খারাপ করে কচু বাড়ি নিয়ে যেতাম। এবার ১৫টা কচু মিরাশা বাজারে উঠাইছিলাম। এখন দেখতাছি, ঢাকা থেইকা আসা ব্যবসায়ীরা বিদেশে পাঠানোর জন্যে কচু খুঁজতাছে। তাদের কাছে আমার একেকটা কচু বেচছি ১০০ টাকা করে। তারা অবশ্য সব কচু নেয় নাই। বাইছা বাইছা ভালোগুলাই কিনছে।’

মিরাশা চাষিবাজারের সভাপতি জলিল মাদবর বলেন, ‘দেশি বাজারে কৃষক অনেক সময় ন্যায্যমূল্য পায় না। অনেক সময় সবজির ক্রেতাও পাওয়া যায় না। তখন কৃষকের লোকসান হয়। বিদেশে রপ্তানির যে কার্যক্রম এ মাস থেকে শুরু হলো, তা অব্যাহত থাকলে কৃষকের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে দেশেরও লাভ হবে।’

সবজি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড লিংকের প্রোপ্রাইটর রাজিয়া সুলতানা জানান, ‘পদ্মা সেতু হওয়ায় এই অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। তবে বিষমুক্ত নির্ধারিত মানসম্মত সবজি উৎপাদন করতে হবে। সবজির মান ঠিক রাখতে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। জেলা প্রশাসন এমন উদ্যোগ নিশ্চিত করতে পারলে এখান থেকে নিয়মিত সবজি রপ্তানি সম্ভব।’

আরেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএইচ ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষামূলক রপ্তানির জন্য মিরাশা বাজার থেকে গত বৃহস্পতিবার কিছু কচু কেনা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু সবজি কিনে তা ঢাকায় নিয়ে প্রসেসিং করে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে রপ্তানি করা হবে।’

এক বিঘা জমিতে লাউ চাষ করেছেন জাজিরার বিলাশপুর মুলাই ব্যাপারীকান্দি গ্রামের কৃষক বেলায়েত হোসেন। বেলায়েতের ক্ষেতে উৎপাদিত এক কেজি আকারের লাউ সুইজারল্যান্ড পাঠানো হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ইউরোপে প্রথম গিয়েছে তার জমির লাউ। দাম ভালো পাওয়ায় খুশিও তিনি। তার মতে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণেই তাদের উৎপাদিত সবজির চাহিদা এমন বেড়েছে। 

বেড়েছে জমি বেচাকেনা, বসছে শিল্প-স্থাপনা 

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ অঞ্চলে জমিজমার দাম এত বেড়েছে যে, জমি কেনা এখন স্বপ্নছোঁয়ার মতো ঘটনা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামর্থ্যবান ব্যক্তি এখানকার অনেক এলাকায় ভূমি কিনেছেন। উদ্দেশ্য সুবিধামতো কোনো স্থাপনা গড়ে তোলা কিংবা কারখানা, ওয়্যারহাউস, বিপণনকেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলা। হাউজিং প্রকল্পও দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকটি। এদের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে সড়কের পাশের এলাকাগুলোতে। পর্যটনশিল্প, শিল্প-কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এগিয়ে আসছেন বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানাচ্ছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে কলকারখানা স্থাপনের জন্যে চলছে জরিপ। তৈরি হচ্ছে শেখ হাসিনা তাঁতশিল্প, গোসাইরহাটে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বেসরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কোল্ডস্টোরেজ, রেস্তোরাঁ, আবাসন প্রকল্প। এ কারণে বাড়ছে শরীয়তপুরে জমির দাম। ১০-১২ বছর আগে এখানকার জায়গাজমি বেচাকেনা হতো শতাংশ প্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি শতাংশ ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায়। কারণ এই পদ্মা সেতু। এখন এসব অঞ্চলের জায়গা মানুষজন আর বিক্রি করতে চাইছে না। কারণ অনেকে মনে করছেন, পদ্মা সেতুর জন্য সরকার আরও জায়গা অধিগ্রহণ করবে। তখন জায়গার দাম দাঁড়াবে তিনগুণ।

নাওডোবা ইউনিয়নের রোস্তম আলী বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে এখানে জমিজমার কোনো দাম ছিল না। যে জমি বিক্রি হতো ২০ হাজার টাকা শতাংশ, সেই জমিই এখন বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা দরে।

এই ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার শাহিন আলম বলেন, ‘পদ্মা সেতু জমি অধিগ্রহণের সময় প্রতি শতাংশ জমি বিক্রি করেছি ২২ হাজার টাকা দরে। এই জমি এখন প্রতি শতাংশ বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা দরে।’ 

নাওডোবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন ঢালী জানান, পদ্মা সেতু হওয়াতে তাদের জমি এখন সোনার দামে বেচাবিক্রি হচ্ছে। চেনাজানা অনেককেও আর কেনার মতো জমি জোগাড় করে দিতে পারছেন না। 

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান বলেন, ‘এখানকার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেশ কয়েকটি বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠান জরিপ করে দেখছে। আমরা মনে করছি, নদীবেষ্টিত এলাকা হিসেবে এখানে চর ট্যুরিজম বিকশিত হতে পারে। এ ছাড়া গোসাইরহাট উপজেলায় কুচাইপট্টিকে অর্থনীতি জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এ জোন তৈরির কার্যক্রম চলছে।’

কী বলছেন জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা 

শরীয়তপুরে সংঘটিত ব্যাপক পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে জাজিরা উপজেলা চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার বলেন, ‘জাজিরাতে গার্মেন্টস এবং হিমাগার তৈরির জন্য জমি কেনা হয়েছে। শিগগির এর কার্যক্রম শুরু হবে।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জামাল হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণেই রপ্তানিকারকরা এ অঞ্চলের কৃষিপণ্যগুলো নিতে পারছেন। রপ্তানিকারকরা কৃষককে স্থানীয় বাজারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি দাম দেবে। এতে কৃষক লাভবান হবেন। তিনি জানান, ইউরোপে যে সবজির চাহিদা রয়েছে, জাজিরায় তা উৎপাদন হচ্ছে। এখানকার লাউ, জালি কুমড়া, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, ধুন্দুল, পটোল, মিষ্টিকুমড়া, কচু, কাঁচা মরিচ, শিম, পেঁপে, লতি, ঢ্যাঁড়স, বরবটিসহ বিভিন্ন ধরনের শাক নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে চাহিদাপত্র দিয়েছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। 

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সবজি বিপণনে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সম্পৃক্ততা জরুরি। তাই এখানকার কৃষক, আমদানিকারক ব্যবসায়ী, কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই এ জেলার কৃষিকে এগিয়ে নিতে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সভা হয়েছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী কৃষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমন্বিত উদ্যোগে শিগগিরই রপ্তানিকারকদের কাছে জাজিরা জনপ্রিয় বাজারে পরিণত হবে।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা