বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৪৯ পিএম
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৫০ পিএম
বোয়ালখালীর ফুটপাথে এক দশক ধরে জুতা সেলাই করেন শিপ্রা দাস। ছবি: প্রবা
‘চুরি তো করছি না, ভিক্ষাও না। কাজ করছি। খেটেখুটেই রোজগার করছি।’
মাথা উঁচু করে, চোখ তুলে স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললেন ১৯ বছরের নারী শিপ্রা দাশ। তারপর আবারও মনোযোগ দিলেন জুতা সেলাইয়ের কাজে। প্রচুর ধুলাবালি উড়ছে আশপাশে। তিনি তাই কাজ করছেন মুখোশ পরে। পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করছেন অনেকেই। মাঝেমধ্যে গাড়িও চলে যাচ্ছে গা ঘেঁষে। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার, কাজ করে চলেছেন আপনমনে।
প্রায় এক দশক ধরে কখনও বোয়ালখালীর গোমদণ্ডী ফুলতল কখনও উপজেলা সদর এলাকার একচাটি রাস্তার ফুটপাথে বসে মুচির কাজ করে আসছেন শিপ্রা। প্রথমে কথা বলতে চাইছিলেন না, বলছিলেন, কী দরকার ভাই? খেটেখুটে খাই, নিউজ দিয়ে কী হবে?’
তাকে জানালাম, ‘আপনার এই জীবনযুদ্ধের কথা জানলে কিন্তু অনেকেই সাহস পাবে।’ শুনে কী ভেবে বললেন শিপ্রা, ‘ঠিক আছে। কী শুনতে চান, বলেন।’
তারপর কথায় কথায় ফেলে আসা দিনগুলোয় ফিরে গেলেন শিপ্রা। যা এর আগে কাউকে বলা হয়নি। যা এর আগে কেউ শুনতে চায়নি। কতই বা বয়স তখন তার, সেই ১১-১২ বছর বয়সেই তাকে গার্মেন্টসে চাকরি করতে পাঠিয়ে দেয় তার পরিবার। অবশ্য কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ, দুবেলা দুমুঠো খেয়েপরে বেঁচে থাকার আশায় তখন তারা গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মজলিশপুর ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে এসেছিলেন। বাবা রতন দাশ গ্রামে কৃষিকাজ করতেন, মা সুশীলা দাশ করতেন ঘরদোরের কাজ। কিন্তু চট্টগ্রামে এসে শুরু হয় জীবনের নতুন এক পর্বÑ যখন যে কাজ মেলে, সেটি করেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে থাকেন তারা।
তিন বোন আর এক ভাই শিপ্রার। লেখাপড়া আর হয়ে ওঠেনি। বড় ভাই সুমন দাশ বিয়ে করে পরিবার নিয়ে এখন আলাদা থাকেন। বড় বোন শিল্পী দাশও বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। ছোট বোন শুক্লা দাশ কাজ করছেন বোয়ালখালীর একটি গার্মেন্টসে। শিপ্রার মায়ের বয়সই এখন ৬০ পেরিয়েছে, বর্তমানে তারা ভাড়া বাসায় থাকেন ফুলতলের মোবারক আলীর শেডে।
মাত্র ১১-১২ বছর বয়সেই শুরু হয় শিপ্রার খেটে খাওয়া জীবন; বিয়ে হয় ১৭ বছর হতে না হতেই। ৯ মাস পরই ভেঙে যায় সংসার। ১৯ বছরের দিকে একদিন গাড়ি দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায়। দেড় বছর ভুগে সুস্থ হলেন বটে, কিন্তু শারীরিক সক্ষমতা আর ফিরে এলো না পুরোপুরি।
শিপ্রা বললেন, ‘উপায় না দেখে নিজেই খুঁজে নিই বাঁচার পথ। ফুলতল কিংবা সদরে জুতা সেলাই আর পলিশের কাজ করতে শুরু করি। কোনো প্রশিক্ষণই ছিল না। চেষ্টা করেছি কাজটি মনোযোগ দিয়ে করার। অনেকে অনেক কথা বলেন, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। দৈনিক ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করি। মাঝেমধ্যে ৮০০ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। তা দিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।’
জীবনের এই সংগ্রামকে সহজভাবেই নিয়েছেন শিপ্রা। তার ভাষায়, ‘কাজ করে খাই। সবাই তাই সম্মান করেই কথা বলে। ফুটপাথ থেকে আমাকে এখনও কেউ তুলে দেয়নি। পুলিশও কিছু বলে না। আমার কথা সোজা, কাজ করেই বেঁচে থাকতে চাই আমি। আর কাজের জন্য একটি বসার জায়গা পেলেই তা হবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।’