চুয়াডাঙ্গা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:২৯ এএম
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪০ পিএম
শুক্রবার শূন্যরখায় ভারতীয় নাগরিকের মরদেহ দর্শন করে বাংলাদেশি পরিবার। প্রবা ফটো
অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় আগে দেশভাগ হয়েছে। ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে যার যার ভূখণ্ডে স্বকীয়তার স্বার্থে। সেই সীমানা ঘিরে পাঁচিল তৈরি হয়নি; বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। তবে এপারে-ওপারে রয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন আবেগ। সীমান্তের শূন্যরেখার বাসিন্দাদের এ আবেগ সবচেয়ে বেশি তাড়িত করে।
শূন্যরেখার এপারের সঙ্গে ওপারের বসবাসকারী অনেকের সৃষ্টি হয়েছে পারিবারিক বন্ধন। যে বন্ধন ছিন্ন করা যায় না কাঁটাতার কিংবা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে। তেমন এক সত্তোর্ধ্ব নারীকে মৃত্যুর পর নিয়ে আসা হয় এপারে থাকা সন্তানদের কাছে। মাত্র আধা ঘণ্টার এ দর্শন শুধু ওই বৃদ্ধের পরিবার নয়, পুরো এলাকার মানুষকে আবেগতাড়িত করেছে। শত নারী-পুরুষ উপস্থিত হয়ে সিক্ত হয়েছেন চোখের জলে।
শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) বিকালে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চুয়াডাঙ্গা ব্যাটালিয়নের মুন্সীপুর বিওপি এলাকার সীমান্তের প্রধান পিলার ৯৩-এর কাছে সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণভাবে তার মরদেহ দর্শন করে পরিবার।
এই সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের কুতুবপুর-মুন্সিপুর গ্রাম। আর ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাটখোলা গ্রাম। মাঝে একটি খাল। এক সময় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। তখন এই পথ দিয়ে দুই বাংলার মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল। দুই পারের বহু মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আত্মীয়তা।
পরিবার ও বিজিবি সূত্রে জানা যায়, ওই বৃদ্ধের নাম ফজিলা খাতুন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চাপড়া থানার হাটখোলা গ্রামের মৃত আবদারের স্ত্রী। শুক্রবার সকাল ৬টায় মারা যান ফজিলা খাতুন। তার দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পীরপুরকুল্লা গ্রামে। মায়ের মৃত্যুর পর এক নজর দেখতে বিজিবির কাছে আবেদন করেন দুই মেয়ে। পরে বিজিবির পক্ষ থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গে আলোচনা করে ওই বৃদ্ধার মরদেহ শূন্যরেখায় আনা হয়।
ফজিলা খাতুনের দুই মেয়ে ডালিমন খাতুন ও রাবেয়া খাতুন। তাদের বিয়ে হয়েছে কুতুবপুর গ্রামে। এ ছাড়া এই গ্রামে ফজিলা খাতুনের দুই ভাতিজি শাখের ভানু ও সোনা ভানুর বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমান্ত ঘিরে ফেলেছে ভারত। হাটখোলা গ্রামটি পড়েছে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে। এই গ্রামের বাসিন্দা ফজিলা খাতুন।
ফজিলা খাতুনের বড় মেয়ে ডালিমন খাতুন বলেন, ‘আমার মায়ের মুখটুকু শেষবারের মতো দেখতে পেয়েছি। বিজিবি ও বিএসএফকে ধন্যবাদ জানাই এ সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তবে মায়ের শরীরটা একটু ছুঁয়ে দেখতে পারলাম না। গোসল নিজ হাতে দিতে পারলাম না। খুব শিগরির পাসপোর্ট ভিসা করে যাব মায়ের কবর দেখতে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ৩ ভাই ৩ বোন। দুই বোন বর্মমানে বাংলাদেশে আছি। বাকিরা ভারতের হাটখোলা গ্রামে। আমার বিয়ের সময় সীমান্তে এতটা কড়াকড়ি ছিল না। তখন এখানকার খালে পানি ছিল। নৌকায় চড়ে মানুষ যাতায়াত করেছে। আমার বিয়ে হয় কুড়লগাছি গ্রামের আনন্দবাজারে। আমার বিয়ের ১০ বছর পর ছোট বোন রাবেয়ার বিয়ে হয় কুতুবপুরে।’
কুতুবপুর গ্রামের ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ। বিজিবি ও বিএসএফ আমাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি এই মানবিক কাজগুলো করে। এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’
বিজিবির চুয়াডাঙ্গা ব্যাটালিয়নের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ মো. ইশতিয়াক জানান, বিষয়টি মানবিক। বিএসএফকে জানানো হলে তারা মানবিক উদ্যোগে সাড়া দেয়। শুক্রবার বিকাল পৌনে ৪টা থেকে সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত মুন্সীপুর সীমান্তের শূন্যরেখায় ওই নারীর মরদেহ শেষ দর্শন করে পরিবার।
তিনি বলেন, ‘সীমান্তে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সব ধরনের কার্যক্রম করে বিজিবি ও বিএসএফ। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক উন্নয়নে প্রায় মানবাত্মামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এতে সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে সুসম্পর্ক সাধিত হবে। যা ভবিষ্যতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।’