গাইবান্ধা সংবাদদাতা
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:০২ এএম
আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৫৬ পিএম
গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটী গ্রামের চিকিৎসক নুরল ইসলাম সরকার। ছবি : সংগৃহীত
এক ফোঁটা ওষুধে রোগ নিরাময়ের চিন্তা মাথায় নিয়ে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মানুষটির নাম নুরুল ইসলাম। শুরুতে পাঁচপাইয়ে এক পুরিয়া হোমিও ওষুধ দিতেন বলে লোকমুখে নাম হয়েছে পাঁচপাই ডাক্তার। মানুষের বিপদের কথা শুনলে বসে থাকতে পারেন না তিনি। অসুখ-বিসুখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা করতে পারলে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি নিজে নিজেই হোমিও চিকিৎসা পদ্ধতি রপ্ত করে ৭৬ বছর ধরে সেবা দিয়ে আসছেন তিনি।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটী গ্রামে গৃহস্থ বাবা রজ্জব উদ্দীন সরকার ও মাতা নয়া বিবির সংসারে ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন নুরল ইসলাম সরকার। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট তিনি। এখন তার বয়স ৯৬। বাড়িতে বসে থাকতে পারেন না। তাই শহরের পুরাতন বাজারের একটি দোকানে বসেন রোগী দেখতে। দেশ-বিদেশ থেকে জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত মানুষ আসেন তার সঙ্গে দেখা করে ওষুধ নিতে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটি এখনও কাঠের ভাঙা চেয়ার-টেবিলে বসে মানুষের রোগের ইতিকথা শোনেন, দেন সেই অনুযায়ী ওষুধ।
স্ত্রী জমিলা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। পৈতৃক সূত্রে পান ৩০ বিঘা জমি। কাজেই টাকার খুব বেশি প্রয়োজন হতো না। একপর্যায়ে সংসার বড় হতে থাকে। একে একে পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের জনক হন নুরুল ইসলাম। কলেজে পড়ার পাশাপাশি হোমিও বই পড়াশোনা করতে থাকেন। তিনি মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে চালিয়ে যান চিকিৎসাসেবা। সেখান থেকেই তার অনুভূতি জাগে কীভাবে অল্প খরচে মানুষের সেবা করা যায়। একজন হোমিও ডাক্তারের কাছে শিখে নেন হোমিও চিকিৎসা। তারপর নিজ গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতেন। ওষুধে সুফল পেলে বিস্তার হতে থাকে তার চিকিৎসার খবর।
বাবা-মায়ের দেওয়া নাম নুরুল ইসলাম সরকার। কিন্তু সারা দেশে ছোট-বড় সবার কাছে পরিচিত পাঁচপাই ডাক্তার নামে। ৯৬ বছর বয়সেও একইভাবে হোমিও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার ওষুধ ম্যাজিকের মতো কাজ হওয়ায় সুনাম ছড়িয়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। তাই প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে ভিড় করে নতুন নতুন রোগী। রোগ ভালো হওয়ায় হোমিও চিকিৎসায় সফল এই মানুষটি স্থান করে নিয়েছে হাজারো মানুষের হৃদয়ে। তবে তিনি বলেন, উপার্জন নয়, মানুষের সেবা করেই আনন্দ পান তিনি।
শহরের ব্রিজ রোডের বাসিন্দা আবুল হোসেন জানান, নুরুল ইসলাম টাকা-পয়সার দিকে কোনো নজর দেন না। শুধু ওষুধের দাম দিলেই খুশি। ছাত্র অবস্থায় তিনি শখের বশে বিনা পয়সায় মানুষকে হোমিও চিকিৎসা দিতেন। পরে তার চিকিৎসায় অসুস্থ মানুষ যখন সুস্থ হতে থাকেন, সেটি দেখে তিনি আনন্দ পেতেন। মানুষের সুস্থতার আনন্দ তার মনে এক অন্যরকম অনুভূতি জাগিয়ে দেয়।
গাইবান্ধা শহরের কালিবাড়ি পাড়ার বাসিন্দা দেবাশীষ দাশ বাদল। তার মাথায় টিউমার হয়েছিল কয়েকটি। ডাক্তার অপারেশনের কথা বলেছিলেন। অনেক টাকার ব্যাপার। টাকা খরচ করার সামর্থ্য তার নেই। তাই প্রতি পুরিয়া ওষুধ ১০ টাকায় পাঁচপাই ডাক্তারের কাছ থেকে দুই বছর ধরে খেয়েছেন। এখন তিনি সুস্থ।
রংপুরের গঙ্গাচড়া থেকে বাস ধরে পারভিন বেগম পাঁচপাই ডাক্তারখানায় এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সংসার যায় যায় অবস্থা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে টিউমার হয়েছে। বড় বড় ডাক্তারের কাছে ওষুধ খেয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি। টিউমার আরও বেড়েছে। তাই শেষ চিকিৎসা করতে এখানে এসেছেন।’
গত রবিবার ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এসেছেন শেখ আবদুর রহমান মিয়া। তার স্ত্রীর গোপন রোগ, মেয়েরও তাই। শরীরজুড়ে নানা রকম দাগ। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন, ওষুষ খেয়েছেন লাখ লাখ টাকার।। তাতে কোনোা কাজ হয়নি। তাই মানুষের মুখে শুনে তিনি সপরিবারে আসেন পাঁচপাই ডাক্তারের কাছে।
চিকিৎসা নিতে আসা গাইবান্ধার প্রবীণ ওমেদ আলী বলেন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর সেবার ব্রত নিয়ে ছাত্রজীবন থেকে নুরুল ইসলাম দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসাসেবা। সেই সময় ওষুধের দাম ৫ পয়সা নিতেন বলে লোকে তার নাম দিয়েছে ৫ পয়সার ডাক্তার। তার চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়ায় তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে গাইবান্ধা জেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে। বাড়িতে রোগীদের ভিড় সামলাতে এবং তার চিকিৎসাসেবা ছড়িয়ে দিতে শহরের পুরাতন বাজারে একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসতে শুরু করেন।
তার বড় ছেলে জহুরুল হক রাজা জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে ওষুধ নিতে আসে প্রতিদিন তিন-চারশ রোগী। এ ছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা মোবাইল ফোনে সমস্যার কথা জানিয়ে ওষুধ পান কুরিয়ার সার্ভিসে। তবে এখন ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় পাঁচ পয়সার বদলে দিতে হয় শুধু ওষুধের দামটি। দুপুরে দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে তিনি সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি। এখনো চশমা ছাড়াই লেখেন এবং কানেও শোনেন ভালো। শক্ত মনোবল আর মানুষের প্রতি ভালোবাসাই তাকে এনেছে এতটা দূর।
পাঁচপাই ডাক্তার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি স্বশিক্ষিত ডাক্তার। বই পড়ে শিখেছি হোমিও চিকিৎসা। ওষুধ খেয়ে রোগে আক্রান্ত মানুষ আরোগ্য হয়েছে বলেই আজ আমার নামও পরিবর্তন হয়েছে।’